Tuesday, May 8, 2018

ওরা ওখানেই আছে...

আমাদের ছাদ দেওয়া ঘর নয়।

ঘরের চালের ঢাল লম্বা বারান্দার মাথার উপর দিয়ে ঝুঁকে পড়েছে উঠোনের এলাকায়, জাফরি কাজের বারান্দা লাগছে যেন আধ কপাল ঘোমটা দেওয়া কর্মরতা পাড়াগেঁয়ে গেরস্ত বউ।

ঘোমটার কিন্তু অনেক রকমফের হয়।

শউর ঘর হতে বাপের ঘরে যাওয়ার কালের ঘোমটা আর উল্টো পিঠে আসার ঘোমটা কিন্তু মোটেও এক নয়।
আবার ধান সেদ্ধ করার সময়কার ঘোমটার সাথে কাঁথা সেলাইয়ের সময়কার ঘোমটাতে ফারাক বেশ খানিক।

তাই বললাম কর্মরতা। সে ঘোমটা কিছু অন্যরকম কিনা।

ধ্যুস কী বলতে বসে কী বলতে লেগেছি!
যাক গে যাক, তা সেই ঘোমটায় গড়া হাসিমাখা মুখখানিতে ঠোঁটের ফাঁকে দাঁতের সারি উঁকি দিচ্ছে যেন এমন কটা নিকোনো ঝকঝকে সিঁড়ি।

সিঁড়ির আবার বিশেষত্ব আছে।

দু পয়সারই হোক কী দশ পয়সার, জমিদার বাড়ি হলেই পুষ্করিণী থাকবেই আর বলাবাহুল্য ঘাটও থাকবে। এইবার সেই ঘাটের কাঠামো মনের চোখে দেখে নিন।

সার সার সিঁড়ির দুই পাশে তাদের আগাগোড়া আগলানো ধাপে ধাপে বেঁটে পাঁচিল মতো আকৃতিদের ঠাহর করতে পারছেন? আমাদের ঘরে দুটোকটা সিঁড়ি থাকলেও, ওইরকম খুদে পাঁচিল আছে, তবে কিনা তা একপাশে।

জায়গাটা আমার ভারী প্রিয়।

পড়াশোনা করা এবং করানো যথাক্রমে আমার ও বাবার বিশেষ প্রিয় কোনও বিষয় নয়, যেটুকু করতে হবে মায়ের হস্তধৃত হিলহিলে পাঁচনের ডরে সেটুকু খুবসকালের পাঁচন গেলার মতো সেরে নিয়েই সিঁড়ি তে আসীন জনক দুহিতা।

গল্প, গল্প আর গল্প।

বাবা পইঠায় আর আমি পাঁচিলে পা ছড়িয়ে। কোলে মুড়ির বাটি।
যেদিন যেমন গল্প, সামনের আবছায়া মাখা উঠোন সেদিন তেমন সাথ দেবে।
অভিযান কালাহারি বা সাহারাতে , সে হয়ে গেল বালুময় মরুভূমি।
যুদ্ধ ওয়াটার্লু বা কলিঙ্গে, উঠোন ঘেরা গাছেরা সব সৈন্য দল।
এরকমই একদিন কল্পনায় সামনের আবছায়া মাখা চন্দন রঙা মাটি তখন মা গঙ্গা কারণ বাবা গল্প বলছে আকাশ গঙ্গার।

গুণ করা বলে একটা কথা আছে। বশীকরণ। আকাশ গঙ্গা আমায় বশীকরণ করেছে।

খেলতে গিয়ে চটজলদি "হুশ" হয়ে মাঠের মাঝে খাড়া আমি দাঁড়িয়ে থাকি মাথাটা প্রায় পিঠে নুইয়ে, খেলা সম্পর্কে বাস্তবিকই বে-হুঁশ। খেলুড়েরা রাগ করে ক্ষোভ প্রকাশ করে তারপর একলা ছেড়ে দেয় আমায়।

আমি সেই আলোময় ছায়াপথ খুঁজে ফিরি। চওড়া রাস্তা। ঘুমের মতো নির্ভার, ভরসার মতো মোলায়েম। আশ্বাসের মতো নিটোল। আমার খুব দরকার ওই পথে পৌঁছানোর পথটার হদিশ।

কেন?

আমার একটা নিশ্চিন্তিপুর আছে। অর্ধেক অর্ধেক রাখা। আমার বাবার বুক। মায়ের কোল। মুখ ডুবোলে স্কন্ধকাটা থেকে ভোঁদড় কারোর ভয় চোখে লেগে থাকে না।

কিন্তু, বাবার নেই।
আমি শুনেছি মাঝঘুমে তন্দ্রা হালকা হয়ে এলে বাবা মা কে বলছে কাকজোছনায়  বিজয় সরকারের, আব্বাসউদ্দীনের গান গেয়ে ঠাম্মার চিঁড়ে কোটার গল্প। ঘোর বর্ষায় চিত্রার পাড়ের বুকজল ঠেলে ঠাকুদ্দার ছোট ছেলেকে শুকনো ইশকুলে পৌঁছে দেওয়ার গল্প। মধুর আমার মায়ের হাসি গান খানা কোনও দিনই বাবা পুরোটা গায় না। থেমে যায়। আধখানা গান টলটল করে উদাসী চাওয়ায়।

মায়েরও নেই।
কালবোশেখির ঝঞ্ঝার শেষ দুপুরে, উলোটিপালোটি খায় গাছগাছালি, উপড়ে পড়ে শব্দ পাই। আমি শুয়ে থাকি কাঁথা জড়িয়ে মায়ের ওমে, মা বলে চলে কীভাবে দাদুর অকাল মৃত্যুদিনে এইভাবেই উপড়ে গেছিল কিছু গাছ, কিছু সম্পর্ক, কিছু সুস্থ সুন্দর ভবিষ্যৎ। ঝড় হয়েছিল, কিন্তু তা অদেখা। কেবল দাপটটা দেখেছে বহু বছর ধরে। অকারণেই বেশি করে আঁকড়ে ধরে আমায়। ঘুম পাড়ায়।

কতো মানুষের কতো খালি খালি জায়গা থাকে বুকের ভিতরে। হু হু করে হাওয়া বয়। মড়ার খুলির ভিতরে হাওয়া গললে আওয়াজ ওঠে শিঁ শিঁ। ওই খালি খালি জায়গাগুলোতেও অমন শব্দেরা ওড়ে। মানুষ ভয় পায়। তাই কাঁদে।

সতীন ঝেঁটিয়ে দেওয়া সন্ধ্যা পিসি কাঁদে। পেটে পুঁজ ভরা দীনু কাকু কাঁদে। তালাক পাওয়া পেট বাঁধানো আলেয়া কাঁদে। ধুতিতে বাহ্য করেও মালুম না পাওয়া ক্ষেপা গদাই কাঁদে।

আমি ঠাহর পাই।

এদের সবার জন্য ওই পথটা খুঁজে পেতেই হবে। যার যা হারিয়েছে, যার যা নেই, সব না কি ওই পথের বাঁকে বাঁকে জমা করা আছে। কালো কালো চোখ চলেনা ঘর সব। তাতেই বন্দি। ওই কাল কুঠুরিতে জব্দ হওয়ার আগে পথের নিশানা দিতে এখানে ওখানে জ্বালিয়ে গেছে আলোর মশাল। ওরা বসে আছে পিত্যেসে। কেউ আসবে। ওদের চিনবে। ফিরিয়ে নেবে।

কেউ যায় না।

কিন্তু সেখানে যে যেতেই হবে।
...
অ্যাস্ট্রোনমির কোর্স করাকালীন টেলিস্কোপে চোখ রেখে ফোকাস করতে করতে ছেলেবেলার আকুতি খুব মনে ভাসতো।
বোকার মতো ইচ্ছে করতো একবারটি দেখার।
যেখানে,
কেউ যায়নি।
কেউ যায়না কক্ষনো।

ওরা ওখানেই আছে।
আজও।

No comments:

Post a Comment