Saturday, October 8, 2022

সুপূর্ণা রণজয় সিরিজের কবিতা


– জানিস সুপূর্ণা, কোনও কোনও প্রেম দাঁড়ঝাঁকানি ঘমণ্ডী কাকাতুয়া। ঝুঁটিফুটি বাগিয়ে সে এক দস্তুরমত আড়ম্বরী আশনায়।

– টেকে না...

– একেকটা আবার, ঝিমলাগা ঝুমদুপুরে আঁতেল গেরেমভারী ঘুঘুটি। কিঞ্চিৎ ডাঁয়েবায়ে থুত্‌নিটি নাচিয়ে ব্যারিটোনে দিল দেয়।

– থাকে না...

– দুচারটে এমন, হরদম কিচিমিচি সাজুনেগুজুনে ছটফটি টিয়ারা। লাফিয়ে চিক্‌রিয়ে এক ঠোঁটেমাখা ভালোবাসা বাত্‌লায়।

– বোঝে না…

– উফফ! থামবি?

– কী হলো! বলবি?

– সবই তোর টেকে না থাকে না আর বোঝে না! সুপূর্ণা, কোন বুকেই ভালোবাসা কি বাঁচে না?

– জানিস রণজয়,

আরেক সে প্রেম দুই সিধেসাদা গেরস্তঘর চড়াই। দিনভর ব্যস্ততা, সন্ধেয় দুটি বাঁধে সোহাগকে আচঁলায়। 

– আজকাল বুঝলি, মোটেও অমনটা হয় না!

– জানিস ভারী, তোর আসল প্রেমতো সয় না!


(এভাবে, 

গোধূলি জোগায় কথোপকথন বাঁধুনী,

দুজনায় গড়ে চাপানউতোরে বিনুনী। 

হঠাৎ,

বিকেলে মিশছে পূরবী নিজেকে রাঙিয়ে, 

কনে দেখা আলো তর্কটা দিলো থামিয়ে।)


– অমন বুকে বাঁধবি সুপূর্ণা?

– এমন ভালোবাসবি, রণজয়?



– রণ,

কাল রাত জুড়ে চোখে টায়টায় আকাশ ছিল আমার।

বিহান বয়সী প্রেম তালাশে ফিরেছি তারাময় অবয়বে।

সাঁঝ বয়সে এ কী নির্লজ্জ বিচ্যুতি রোজনামচার।

কালপুরুষে আজও তৃষ্ণা আকণ্ঠ জাগে অপার্থিবে!

– পূর্ণা,

কুহকী নিশির ডাকে সাড়া কাল দিলাম অমানিশায়।

আশরীর মেখে নিলাম অশরীরী অতীতচারিতা।

প্রাক্‌প্রৌঢ় গুজরান মৌতাতে তরর্ বেহুদা নেশায়।

অ্যান্ড্রোমিডা আজও চোরাচাউনির সেই অবগুণ্ঠিতা!

– ইশশ্! কতো বেলা হয়ে গেল।

– আহ্! এতো বেলা বয়ে এলো।


(এই যাপনের সমস্তটাই নিষিদ্ধ। 

এই যাপন ব্যর্থ-প্রণয় নিষিক্ত।

তাই বলে কি অ্যান্ড্রোমিডা

তাই বলে কি কালপুরুষ

মুছে দেবে রাতের জীয়ন? 

ধ্যাত্ ধুর্ হ্যাটট্ হুউউশশ্!)



– ধরে নে পূর্ণা, দেখা হল দীর্ঘ অথবা স্বল্প আগামীতে, হয়তোবা কালই। 

কী ঘটবে বলতো তাতে? 

চূড়ান্ত নালেঝোলে মাখা আহাম্মকি কিছু করব আমি,

বা তুইই কি?

দুই অজন্মা হাড়হাভাতে!  

– নাহ, মনের শরীর বয়স্কা হয়েছে রণ,

নিপুণ শৈল্পিক দক্ষতা জন্মেছে আড়াল করার।

রাগ থেকে রিরংসা, ক্ষোভ থেকে ক্ষিপ্ততা,

প্রেম থেকে অভিমান, দাবী থেকে চাহিদা

সব সব সব... আবডালে রাখি আমি।

মধ্যবিত্ত গৃহস্থের ঢলোঢলো গৃহিনী। 

কোয়েলের মোড়কে হাড়গিলে গৃধিনী!

– (তুই হেঁটমুণ্ডু পায়ের নখে মাটি খুঁড়তিস আর আমি ঊর্ধমুণ্ডু নারকোল পাতায় লটকানো মেঘের টুকরো গুণতাম।

তবু আমরা পরস্পর কে ছুঁয়েই রইতাম,

নির্জলা তৃষ্ণা আর নিস্ফলা অঙ্গীকার আকণ্ঠ ধারণ করতাম। 

মনে আছে?)

– (তোর লড়ঝড়ে সাইকেলটার মতই আমাতে একচোখা ছিলি বড়ো, দুর্নিবার একরোখাও।

ক্ষীর গুমোরে নাকের পাটা ফুলত আমার,

আবার ঘাম জমত তেলোতে তোর দস্যিপনার ডরে। 

মনে পড়ে?)

– কিছু বললি?

– নাতো?

– তুই কি কিছু?

– নাহ।...


(ভ্রাম্যভাষ স্তব্ধ।

ওরা নিশ্চুপের বাক্যালাপে মগ্ন।

সব কথা কি ঠোঁট নেড়ে বলা যায়!)


8


– সব ভিজে যাচ্ছে রণ! সব সব সবটা ভিজছে।

ভোর থেকে দুপুর, আলসে থেকে উঠান, কেয়ারি থেকে আগাছা, বেড়াল থেকে দাঁড়াশ, সাইকেল থেকে ল্যাম্পপোষ্ট, কুমুদিনী থেকে আত্মদীপ প্রকৃতি ভিজেই চলছে! 

– অহং থেকে অভিমান, লালসা থেকে প্রেম, গ্লানি থেকে তৃপ্তি, হাঁটা থেকে পিছুটান, ন্যাকামি থেকে ফুসলানো, ঘৃণা থেকে চাহিদা পুরুষ ভিজেই চলছে! 

– সব্বাই মরে যাচ্ছে রণ, আকণ্ঠ মরেই যাচ্ছে।

– কী অকুণ্ঠ ভালোলাগায় কী উদ্দাম ভালোবাসায় তীব্রতম আশ্লেষে বৃষ্টি খিঁমচে ভিজতে ভিজতে চুপ্পুর মরণ সবার! 

– কেবল আমি যতটা শুকনো ততটাই শুকনো থেকে গেলাম। 

আজও। আজকেও।

তুই এলি না।



– দিতে পারো ওই এক কুশী কাকচক্ষু মরম জল?

ধ্রুবশুভ্র চন্দনগন্ধী।

ঠোঁটের কষ ছুঁয়ে নামলো যা এক্ষুনি। 

কথা দিচ্ছি।

মুহূর্তে বিলিয়ে দেবো অতৃপ্তির আযৌবন অহংকার।

নতজানু পরিতৃপ্ত একান্ত প্রেম হবো।

একবার। আরেকবার। অন্তিমবার।

– রুধির তো তীরের পিপাসা মেটায়।

কিন্তু তৃষ্ণা যে তৃণীরেরও থাকে সুপূর্ণা।

তুই কবে সেটা বুঝবি বল?



– নিজেকে শোনা হয়না বহুদিন। 

এঁকে ওঁকে তাঁকে শুনতে এবং বুঝতে আর জানতে এবং যুঝতে গিয়ে, 

এই ওই সেই ইত্যবসরের ইত্যাদিগুলোতেই, 

অনুপল থেকে অনাদি অবধি কাবার!

নাহ্,

আজ আমি পাশটায় শোয়াব, নিজেকে। 

আজ আমি শুনব শোনাব, নিজেকে।

তারপর

গলা জড়িয়ে ঘুম পাড়াব, নিজেকে।

শান্তিতে ঘুমিয়েছে বিশ্বাস করব।

এরপর

স্বস্তিতে ঘুমিয়েছি ভাবব নিজেও।

মিছিমিছি...

আসলে, সেই সে রাতটা না এলে কি সেইসে ঘুমটা আসতে পারে বা আসতে চায়?

শোনা কিম্বা শোনানোগুলোও কি হয়, আদৌ?

– রাতটা আবার কবে আসবে সুপূর্ণা?

– রাতটা সেবার কবে এসেছিল রণজয়?



– আসলে ঘটনাটা হল এই যে, তোকে খুব করে ভালোবাসি বোঝা ও বোঝানোটা (সাধ কতো!) খানিক খানিক কোনও গতিকে যদিওবা হয়ে উঠল শেষমেষ,

কিন্তু

আদতে বাস্তবটা হল এই যে, তোকে খুব করে ভালোবাসি বলা ও বলানোটা (স্পর্ধাও হয়!) এতটুকুও তো শেষ ইস্তক আর হয়ে উঠল না।

আর ইদানীন্তন এটা তো তুই জানিসই (মানিসও!) যে বলাটা কী দুর্বার রকমের অবশ্যপালনীয় দরকার।

– চোখ খুলে বা চোখ বুঁজে যাই কিছু ছুঁই বা ছুঁয়ে যাক, সমস্তটা আগাপাশতলা বলাটা দারুণ জাতের এক সামাজিক (মরণ!) দায়িত্ব ও কর্তব্য।

– এইবার বিবাদ (বাওয়াল?) তো অন্যত্র বন্ধু। সত্যি বলতে কী বিসম্বাদটা (ক্যাচালটা?) সেখানেই।

– উথালপাথাল শোকে একলা লেখার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে যখন তোর ভেবে নেওয়া (একশো শতাংশই কি?) জড়িয়ে ধরাটা মনকে (শরীরকে নয়?) দিয়ে থাকি, প্লাবনের পলিমাখা গাঙ আলের খেজুর গাছ হয়ে উঠি। 

আমি তো নাচার।

এমন কোনও তৃপ্তিময় খেজুর গাছের ঠিকানা চলতিতে পেলে শুধোগে যা, বলা না বলা ফিলিংসের কিস্যাগুলো।

– কালচে নীল ভয় মাখা শিরদাঁড়া কোঁকড়ানো ডিভানে অনেক রাতে যখন তোর ধরে নেওয়া (একশো শতাংশই কি?) বুকে মুখ মাথা (নিজেকে নয়?) গুঁজে ঘুমিয়ে পড়ি, মাতৃগর্ভস্থিত নিশ্চিন্ততা ডোবানো আহ্লাদী ভ্রূণ হয়ে উঠি। 

আমি তো নাচার।

এমন কোনও ঘুম জড়ানো ভ্রূণের সাকিন চলতিতে পেলে তাকে শুধোগে যা, বলা না বলা ফিলিংসের কিস্যাগুলো।

– রণ, সবটা বলা হয়ে উঠলো না রে। সবটা বলা হয়ে উঠবে না।

– সবটা বলবো না।

বলবোই না।

– যাক, বেঁচে গেলাম!



– নৃশংস বিষণ্ণ কাউকে দেখেছিস কখনও সুপূর্ণা?

– কী?

– এই ধর চরদিগর বিধ্বংসী এক সাগরী ঝঞ্ঝা, তার আগ্রাসনের কর্কশ চিহ্ন ছড়িয়ে, দাজ্জাল তাণ্ডব সেরে চলে গেছে কিছুমাত্র আগে, কিছু পরে হয়তো দাঁড়িয়ে আছিস সেই ক্ষোভে ফুঁসে চলা প্রতিস্পর্ধী নদী মোহনার পাশে,

দেখতে পাবি তাঁকে।

আবার ধর নোনতা বালিয়াড়িতে এক ইবলিশের বাচ্চা ঢেউ, ব্যাঙের লাখান জিভ বিছিয়ে, নাগাল পাওয়ার পর মুহূর্তে সড়াৎ গিলে ফেলেছে তরতাজা ছেলেটাকে,

সেক্ষণে দাঁড়িয়ে আছিস সমস্ত বোধ ঘুলিয়ে যাওয়া মায়ের পাশে, 

দেখতে পাবি তাঁকে।

নাহ, পরাভূতের দিকে চাইলে হবে না।

পরাক্রমীর দিকে চাইলেও হবে না।

খলখল করে ঝাঁপান জোড়া ঢেউ পেরিয়ে চাইতে হবে প্রাত্যহিক রাক্ষুসেপনার ওধারে।

আত্মপক্ষ সমর্থনের কচকচি সরিয়ে,

যেখানে গাঢ় অতি গাঢ় কালচে সবুজ জঙ্গম প্রান্তরেখাগুলি ধারণ করে আছে আদিগন্ত বিস্তৃত এক রাশ পিত্তিরঙ যন্ত্রণা,

যেখানে প্রতিপল অগণন জমাট পিণ্ড হতে চাইছে লুকোনো অনুশোচনা, 

সেই পানে চাইবি। 

তবে দেখা যাবে।

– এত শক্ত কথা আমার বুঝতে ইচ্ছে করছে না রণজয়।

সহজ হ।

আমার তাড়া আছে।

– বেশ, তবে নিত্যদিন আঁচড়ে খামচে খোকার দুধ খেয়ে যাওয়া বেড়ালটাকে গর্তে পুঁতে ওজন সমান লবণ জলে ঢালতে যাওয়া খোকার মায়ের চোখের দিকে চেয়ে দেখিস একবার।

গোক্ষুর যখন মেঠো গুঁড়ো ওড়ায় দৃষ্টি সীমা জুড়ে।

– ঘন অভিমানী এক নৃশংস বিষণ্ণতা।

– এই তো! বেশ বুঝেছিস খানিক খানিক।

এতেই হবে, কিম্বা, যেটুকু বোঝার বাইরে রয়ে গেল সেটুকুর জন্য... নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পারিস।

আজ।

লাল হলুদের ছোপ ধরা এই নিমন্ত্রণপত্রটি হাতে রেখে।

কেমন?

– রণ!

– মনকে ছুঁয়ে যে মিথ্যে বলা যায়না রে পাগলী!



– রোগা নদীটা সাঁঝ গড়ালেই রামধনু রঙ রেশম শাড়ি আজও পরে। 

কতকাল হয়ে গেল বল দেখি, 

কাছাকাছি বসে থাকিনা জল-ছুঁই ঘাটের পৈঠায়।

অনিন্দ্য নৈঃশব্দ্য।

চিলতে আকাশটা আলো দেখলেই তুঁতে চন্দন জামেওয়ার শাল আজও জড়ায়।

কতযুগ পার হল ভেবে দেখ, 

পাশাপাশি হেঁটে পেরোই না ভোর-ছুঁই সাঁকোর জমি।

অলঙ্ঘ্য নৈকট্য।

কিন্তু এটা তো তুমি মানবে বল, 

আমরা তো কোনও এককালে এসবই করতুম কেবল।

খুব রকমেই করতুম, কি না?

মনে পড়ে? আমারই কি পড়ে আদৌ?

– আজকাল কেবল একটা বিরাট চাদর পেঁচিয়ে প্রেতের মতন চলাফেরা করে থাকি। 

বড্ড ভারী ধরণের কালচে রঙ সেটার। 

নাকটা কেবল বেরিয়ে আসে।

আরও ভারী গন্ধ টানে।

ঘন জমাট অভিমান। 

অভেদ্য। অচ্ছেদ্য।

আরেকটি সত্য গন্ধেরও ঝাপটা টের পাই,

অল্পে অল্পে খুইয়ে ফেলছি আমাদের দামী সকলটুকু।

সামান্য হলেও পাচ্ছ নিশ্চয়, নয়?

বোঝ তুমি? আমিই কি বুঝি আদৌ?


১০


– অভিসারের রং জান কি? 

– হ্যাঁ।

– বল তো কী?

– নীল।

– কোনও কোনও আগামীর পথ পাহাড়ি নদীর মত।

তার আঁকেবাঁকে অজস্র শামুক ঝিনুক বাড়ি থাকে, এ নিশ্চয় জান? 

– হ্যাঁ।

– দ্বার খোলা নেই কেবল ঘুলঘুলি হাট করে রাখা।

পথিকের প্রয়াস সর্পিল চলনে বিপ্রতীপ সহজ গতি আঁকড়ে, এও নিশ্চয় জান? 

– হ্যাঁ।

–পথের শেষের খবরাখবর কিছু কি রাখ? 

– না।

– আমি বলি শোন।

শেষে একটা পানিশঙ্খ ঘর থাকে।

কোনও একদিন শ্রান্ত সাঁঝের বেলা সেখানে চলে যেয়ো খুঁড়িয়েই সই, কেমন?

পিয়াস মিটিয়ে এস।

স্রোতস্বিনী ঝামর ঝামর চলে, খলখলিয়ে বলে।

তার গমকে খাদ চড়া উপত্যকায় সে বিষম কানাকানি, এ নিশ্চয় জান? 

– হ্যাঁ।

যোবনবতী পথচলতি ঝোরার ডাকে মিতালি পাতায়।

একবগ্গার মত ছুট দেয় সঙ্গ-মনের সাথে একাঙ্গী তীর্থে, এও নিশ্চয় জান?

– হ্যাঁ।

মোহনাকে সঙ্গম বলে না, এর ব্যাখ্যা কি রাখ? 

– না।

– আমি বলি শোন।

সমুদ্দুরের এতোল বেতোল চিরকালের।

পৃথুলা গজগামিনীর নিয়তিনির্দিষ্ট নিঃশর্ত আত্মনিবেদনে কি ঝাপটানি আশ্লেষ থাকে?

নদীর বয়স হয়ে যায় যে।

যন্ত্রণার রং জান কি?

– না।

– বলি, কী?

– আমি বলি,

– নীল।

– তুমি কাঁদছ?


১১


– ঘোর বর্ষার ঠিক আগে আগে কখন কখন এমন হয়, কোথাও কিচ্ছুটি নেই, ফক্ফকা আলো, হঠাৎ গুড়ুমগাড়ুম শুরু হয়। প্রথমেই তোদের সেগুন গাছের উপরেই যে শুরুটা হয় বা আমাদের নিমগাছখানার মাথায়, তা কিন্তু নয়। 

বুঝলি?

– হুঁ।

– বহু, ধর না কেন বেশ দূর থেকে গড়াতে গড়াতে আসে আওয়াজখানা। চকমিলানো শানের মেঝেয় ভারী নোড়া গড়াচ্ছে যেন একখান। এই এদিক তো এই সেদিক, এই সেদিক তো এই আরেকদিক। হ্যাঁ, বুকের মধ্যেও। 

শুনলি?

– হুঁ।

– তারপর আওয়াজের জোর বাড়ে। বেশ বাড়ে। যাকে বলে সত্যি সত্যি বাজখাই। একসময় মনে হয় চিরে ছিঁড়ে ফেঁড়ে দিচ্ছে এধার থেকে ওধার, গোটা আকাশ। সঙ্গে নীল খুব নীল সরু সরু আলোর চাবুক। সপাং সপাং পড়ে। যেখানেই পড়ে, আকাশটা গোলাপি হয়ে যায়।

দেখলি?

– হুঁ।

– আমার কী মনে হয় জানিস, মেঘের সঙ্গে মেঘুনির সে বড় রকম ঝগড়া হয়। মেঘুনি করে কী, প্রথমে দোর দেয়। তখন তো দাওয়ায় বসে বিরাট তড়পায় মেঘমামা। হা পা ছুঁড়ে ছুঁড়ে সে ভয়ানক হম্বিতম্বি যারে বলে আর কী।

বুঝলি?

– হুঁ।

– হঠাৎ সে মেঘুনি খিল খুলে ফস বলতে ঘরের বার হয়ে যায় ওই হালুম হুলুমের মাঝেই। আর তো তারে পায় না মেঘবাবাজি। খিড়কি সদর আদাড়ে বাদাড়ে না, নেই। 

শুনলি?

– হুঁ।

– এইবার আর যায় কোথায়! এ তল্লাটে সে তল্লাটে খুঁজে বেড়ায় তারে বোকার হদ্দ মেঘটা। বড় হামবড়াই কি না! পায় না, পায় না, কিছুতেই পায় না। রাগে ক্ষোভে অন্ধ হয়ে খোঁজে। ভেতরে ভেতরে হারানোর ভয় যন্ত্রনা দ্বিগুণ করে, নীল খুব নীল সে ব্যথা। যেখানটায় হয়, সব রক্ত সেখানে ছোটে, তাইতেই তো গোলাপি বর্ণ হয়ে পারে। 

দেখলি?

– হুঁ।

– তারপর যখন আর কিছুতেই পায় না, পাবার আশখানা ছাড়ে না। ওটারে বুকের এপাশ ওপাশ জড়ায়ে কাঁদে। খুব কাঁদে। প্রথমে হাউহাউ করে কাঁদে। এরপর ঘ্যান ঘ্যান করে কাঁদতেই চলে কাঁদতেই চলে... গড়িয়ে চলে কেঁদে চলে... কেঁদে চলে গড়িয়ে চলে... নুলো তো, খঞ্জও। মেঘুনি ছাড়া চলে, বল?

শোন না সুপূর্ণা তাই বলছিলাম কী ঈ ঈ...

– বাড়ি যা রণজয়।

...

আশ্চর্য তো! অমন সুন্দর ফুলদানিটা আছড়ে ভাঙলি কেন এভাবে! উফঃ!


১২


– যখন সন্ধে-প্লাবন বৃষ্টি ধরে আসে, রাত তিন কাঠি জড়োর দিকে পা চালায়, পিচ্ছিল গলিপথে পা চালাই আমিও। সরকারি কামিনী গাছের পাশ দিয়ে চিলেকোঠায় ফিরি নিজেকে সেদিনের মত যথেচ্ছ বিকিয়ে। জো হুজুরে জাবনা জুগিয়ে জুগিয়ে মাথাটা সেসময় বিলকুল ফাঁকা চাড়ি। কামিনী গন্ধ তো বড্ড ছিনাল, গায়ে এলানী, তক্কে তক্কে থাকে চাড়ির ডাব্বাটা বাগে পেলেই নিজেকে ঠেসে পুরে দেওয়ার। সবটা জুড়ে রাজ করবেন বেহায়া গন্ধবতী। কিন্তু বাদ সাধে একটা রয়ে রয়ে ডুকরে ওঠা ডাক।

– কীসের সে ডাক?

– সাপের গ্রাসবন্দী ব্যাঙের।

– কীসের!

– ঠিকই শুনলি। আচ্ছা, একটা প্রশ্ন করি। ঠিকঠাক উত্তর দে। সাপটা গিলতে ভীষণ ব্যস্ত, তোকে কামড়ানোর অবসর তার মিলছে না সে মুহূর্তে, এরম লজিক্যাল কম্ফোর্টে এসে ঘিনঘিনে সরীসৃপটার ভয় সরিয়ে রেখে কখনও দাঁড়িয়ে পড়ে মন দিয়ে শুনেছিস মরণত্রাণের ডাকটা?

– নাহ। শুনিনি। সুখশ্রাব্য নয়।

– আমি শুনে থাকি। সুযোগ পেলেই। কটুশ্রাব্য, অথচ অকাট্য আকর্ষণ। মাদী-মুনিষের পিঠের লম্বে লুকিয়ে পড়া ঘাম ফোঁটা খোঁজার শিরশিরানি।

– ইশ! কোথায় চলেছিস!

– ... খাঁজের ভাঁজে...হাহাহা! শোন না, কেতরে কেতরে ডাকে বুঝলি। ডাকটা শুনলেই আমার করোটির ভেতরে একটা ভাইন চারকোল খচখচ দাগ কাটতে থাকে, নাগাড়ে। ধূসর আঁকা তৈরি হয় একখানি। প্রৌঢ়ত্বের খিড়কিদোর ডিঙোচ্ছে এমন এক বাবু তার "বাঁধা"-র প্রসারিত দুই পায়ের পাতার সামনে দাঁড়িয়ে বেনিয়ানখান খোলার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে, বুক আর ভুঁড়ির ঠিক মাঝ ভাঁজের একটা বিষগিঁট খুলছেই না, কিছুতেই না, কিন্তু কোনও গতিকে খুলে গেলেই অন স্পট জিৎ! নইলে বিষম হেরো। ছড়ানো পায়ের মাঝে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বেচারার ইজ্জত ছড়িয়ে লাট। ব্যাঙটাও তেমনই জানকবুল করছে নিজের বুক পিঠের নুনছালটা সাপের আলটাকরার গোড়ায় খসিয়েও যদি বেরোনো যায় মাড়ির বেড়ার বাইরে, ওই, অন স্পট জিৎ। আন্ডাদত্ত জানডা রক্ষা পায় সে যাত্রা।

পারে না রে। বিষগিঁটটার ইশকুলের খাতার নাম জানিস পূর্ণা? নিয়তি। মাড়ির বেড়াটারও।

– এবারে থাম প্লিজ।

– আরেকটু বাকি, একটুই... এই তুই থাম বললি না, তা সেই ডাকটা থামায়-বলায় অদ্ভুতুড়ে রিদ্মিক বুঝলি। কন্টিন্যুইটি আছে, তবে ঐ থামা চলা মিশিয়ে। আমার কেমন মনে হয় ব্যাঙ বাবাজীবন যম-পেষণের কষ্টটা পেটের কুয়ো থেকে টেনে টেনে গলায় তোলে, খানিক কপিকল ঘোরে, কিছুটা পেতলের বাঁকা বালতি কষ্টগাভীন ওঠে, তবে কণ্ঠায় শব্দ জাগে। ফের টান ফের ওঠা ফের ডাক। হ্যাঁ, তর্কে বলতে পারিস বমিও ওভাবেই ওঠে বটে, তবে চরিত্রে একটু ফারাক আছে। বমি টানা বেশ চড়া। হেঁচকা ওঠে সেটা। এরম ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে নয়। ফলে ওঠারও আওয়াজ মেলে, এরম নিরুচ্চারে জাগাটা নয়। আমার অবশ্য সেটা নয়, এটাই বেশ লাগে শুনতে। শিস ঝিম শিস ঝিম...

– তুই কী ক্রমশ অসুস্থ হয়ে পড়ছিস রণ?

– উঁহু, ক্রমান্বয়ে সুস্থ হচ্ছি বলতে পারিস। চল্লাম গো সই। উঁহু আমি বলছি না, ব্যাঙ বলে যায়। শেষ ডাকে। নাহ, বউকে নয় রে, প্রত্যাখ্যাত প্রেমিকাটিকে। তারপরই সাপটা কোৎ করে গিলে ফেলে। গল্প মুড়োয়। ওদিকে ডাকটা চিরল চিরল মিশতে থাকে বাতাসের স্রোতে। পৌঁছয় একদা ফিরিয়ে দেওয়া বেঙিটি অবধি? না কি খুঁজে বেড়ায় বেমিশেল জোড়াটিকে। কে জানে... যে বাতাসে ব্যাঙের বিদায় ডাকের স্বর মেশে সেই বাতাসেই সাপ মেশায় লগ্নডাক আকাঙ্ক্ষী গন্ধ, ভরভরন্ত পেটে তখন তার অপেক্ষা সাপিণীর। প্রতীক্ষা শঙ্খঘোরের।

– শঙ্খ লাগা দেখেছিস কখনও? দেখবি রণ? দেখবি!...

– ও কী ফুল চুলে বেঁধেছিস রে? নাগচম্পা, নয়? রাশি রাশি বিষাক্ত ফণার মাঝে কেমন নিষ্পাপ শুভ্র শরীর। কিচ্ছুটি জানে না, কিচ্ছুটি বোঝে না। হা হা হা! আমি নেশাতুর পেরিয়ে পেরিয়ে চলি এক ল্যাম্পপোস্ট থেকে আরেক ল্যাম্পপোস্টের আঁধার ভুবন। হাত ছোঁয়া দূরে দাঁড়িয়ে, আসলে অলঙ্ঘ দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকিস তুই কিংবা এই, নাগচম্পা। মাঝের বাতাসে শঙ্খ দেখবি ডাক মিশিয়ে।

– উঁহু, আমি তাকে একে অন্য নামে চিনি। প্রেমনলিনী।

– ত্রৈলোক্যমোহিনী হচ্ছিস পূর্ণা? হিসহিসে, খয়েরি জাদুমুগ্ধতা ছেয়ে বসে তোর কণ্ঠমণিতে। নড়তে পারি নে। কোদালে কুড়ালে মেঘে কেঁপে বৃষ্টি হয়। জানিস তো? তোকে দেখলেই আমার অমন খণ্ড খণ্ড মেঘ বলে ভ্রম হয় আজকাল। নীলচে ধবল, জমাট গরলধারা। এদিকে আয়নায় যাকে দেখি রাতে শোওয়ার আগে, জানলা বেয়ে আসা ল্যাম্পপোস্টের গ্যাজলা হলদে আলোয়, দিন কে দিন কেমন কটকটি ব্যাঙের মত লাগে মাইরি। ঘ্যানর ঘ্যানর করে খুঁচিয়ে চলে: "দূরে সভা নিকট জল, নিকট সভা রসাতল।"


কামিনী ফুলের গন্ধ ভারী মিষ্টি। সত্যিই।


১৩


– মনে পড়ে সুপূর্ণা এরম সোয়াটুকু শীত এলে আমরা ফেরার ট্রেন মিস করতাম এক এক দিন সদ্য উজাগর খেয়ালকে থাম্বস আপ করে?

– হুঁ।

– আমার ছিল থুতনিছোঁয়া এক আকাশনীল সোয়েটার আর তোর ছিল হলুদকালো পঞ্চু। সেই হলুদ রঙটা এক্কেবারে সদ্য খোসা ছাড়ানো কাঁচা হলুদের গন্ধ মেশানো যেন আর কালোটা তোর বাম হাতের অনামিকার ডগায় বসা তিলটার মত। ছোট ছিল একটু, অনেকদিনের কি না, সর্বদা কনুই ভাঁজ করে থাকতি বুকের পাশে, সে আমারও হাতাদুটো মণিবন্ধের খানিক উপরেই থাকত তাই পকেটে চালান করা ছাড়া উপায় ছিল না পথচলতি। তোকে কখনও বলিনি পকেটটায় আঙুলগুলো বাধা পেত না, উরু ছুঁয়ে ফেলত নির্দ্বিধায়। শীতল আঙুল পলেস্টার প্যান্টের মোড়কে জড়ানো উরু ছুঁলে কঁকিয়ে উঠত শিরদাঁড়া। বলিনি কখনও।

– হুঁ।

– ট্রেনকে হাত নেড়ে আমরা বসতাম পাঁচ নম্বর প্ল্যাটফর্ম এর সেইই মাথায়। একটা স্বর্ণ চম্পা গাছের পাশে। তুই ইচ্ছে করেই ছোট পঞ্চ যতদূর যায় এলিয়ে দিতি যাতে আমার কনকনে পাতা দুটি ঢাকা পড়ে তোর জমানো ওমে। আমি সংহত ঔদাসীন্যেই হাত রাখতাম। বলিসনি কখনও মুখে আয়, এইখানে হাত রাখ। কখনও বলিসনি।

– হুঁ।

– আমরা কখনও ফুল হতে দেখিনি গাছটায়। কেবল গল্প করতাম কেমন হতে পারে ফুলগুলো। আমরা তো কখনও সংসার হতেও দেখলাম না রে, কেবল নিরুচ্চার গল্প করে গেলাম কেমন হতে পারত আমাদের যৌথ ঘরকন্না।

তোকে কতদিন দেখি না।

পঞ্চুটা নিশ্চিত নেই, তুইও কি আজকাল নিস্পৃহ চাদর জড়াস? ঔদাসীন্যের রঙে চোবানো?

– হ্যাঁ। পুরু কঠিন খদ্দরের থান কাপড়ের চাদর। কুলি লাইনের খালপাড়ের কুয়াশার মত।

তোকে একটা সোয়েটার বুনে দেব। গায়ে হলুদ আর আশ্বিন নীল মিলিয়ে। কালো দিতে বলিস না। অনামিকার তিল ডুবে গেছে চামড়ার নীচে। এখন কেবল আদ্যশ্রাদ্ধের তিল গোছাই।


১৪


– জানিস সুপূর্ণা, হাওয়ার ঝাপটা আসা খোলা জানলার গা-ঘেঁষা টেবিলটার উপরে হাট করে রাখলেও সব উপন্যাসের সব পাতা ফরফর করে ওড়ে না। পড়াটা মসৃণ হয় না। লক্ষ করলে কারণ জানাও যায়। আর্দ্রতা। সব বাতাস দখিনা হয় না যে, কিছু জোলো হয়। স্যাঁতস্যাঁতে। বড্ড ভারী। কামিনী গন্ধের চলন।

– জানি। জল গিলে গিলে সেঁটে থাকে পাতারা, একে অপরের শরীরে। টিঁকে থাকার পারস্পরিক অবলম্বন। লেপ্টে থাকা পাতাদের দুই আঙুলে ঘষটে ঘষটে আলাদা করতে হয়। তবেই এগোয় উপন্যাস। হাওয়াটা বয় তখনও, তিরতির। তার শুভ নাম, পূরবী।

এটা জানিস তুই?

– হুঁ, জানি। সত্যিটা কী জানিস পূর্ণা, প্রত্যহ যাপনও কেবলই ইমনকল্যাণে গড়া হয় না। এর সঙ্গে দরবারী'র আখমাড়াই কলে নিংড়ে নিংড়ে বিন্দুবিন্দু টনটনে অনুভবে তৈরী হয় যে বেঁচে থাকা, সেটাই সম্পূর্ণ অস্তিত্ব। ছটফটানি স্বাভাবিক। আরও স্বাভাবিক ছিঁড়েখুঁড়ে ছিটকে বেরিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা। কিন্তু সঠিক নয়।

নিজেকে গড়তেই পিষতে দিতে হয়।

– হ্যারিসন রোডের সেই পাগলা সানাইওয়ালা কী বলত মনে নেই রণ? শুদ্ধ পীড়ন বড় অমূল্য প্রাপ্তি। জীবন যখন ক্রমাগত পিষে পিষে একসময় খামচে বের করে আনে এক খাবলা দেওয়ালে ঠেসান দেওয়া শ্রান্ত যন্ত্রণা, সানাইরঙা বিকেলে একরাশ শিউলি জড়ো হয় এলোমেলো কোলে। গভীর একাকী স্বরাট ডাক ওঠে নাভীমূল হতে। তারও শুভ নাম, পূরবী।

– সূর্যাস্ত দেখতে যাবি পূর্ণা? আঁধার গাঢ় হলে কেদার শোনাব।

– কী শোনাবি?

"একি গভীর বাণী এল ঘন মেঘের আড়াল ধ'রে সকল আকাশ আকুল ক'রে॥"

– নাহ,

"অমনি চলে যেয়ো নাকো গোপনসঞ্চারে। দাঁড়িয়ো আমার মেঘলা গানের বাদল-অন্ধকারে।"


১৫


“Teri surkh surkh aankhien, yeh batah rhi hain Ghalib, Phir subho kar di tune, usay yaad karte karte.” – Mirza Ghalib


– একটা ঘন বুনোট পাতার বুক আর ঠোঁট, অল্পে অল্পে জমাতে থাকে রিজিকের চাতকজল।

টইটম্বুর হলেই নিজেকে আলতো নুইয়ে ভরাতে যায় কোল ঘেঁষা ঈষৎ মেঘুয়া পাতাটাকে।

হয়তোবা দুঃখপুকুরই দেয় নিজের অজান্তেই, কিন্তু তার সর্বস্বান্ত দেওয়ার ঈহা মিছে নয়।

আকাঙ্ক্ষীর আর্তি তাই আশরীর ধারণ করে দয়িতের গূঢ়-বাঞ্ছা প্রতিকল্প, সিক্ত হয়।

দোঁহার এই ইচ্ছেসুখ আর প্রাপ্তিসুখ নির্নিমেষ গড়ে তৃপ্তিসুখের একঢাল চর দুইয়ের হৃদ মাঝারে। 

গোধূলি-বেলায় ধারাস্নাত মিহি বোধ-ধূলির উঠোনে।

একটি লেফাফা পড়ে থাকে কেবল।

হয়তো আর্চিজ, কিম্বা হলমার্ক।

"বহুদিন পরে ভ্রমর এসেছে পদ্মবনে।"

– রাতটা এখন একটা, বা হবে হয়তো দুইদেড়। ধড়মড়িয়েই উঠে বসল তাঁর মন। 

কে যেন কবে এই কথাটা তাঁকেই দিয়েছিল। 

দেখাবে ফুলেল সেই স্বর্ণচম্পা বন।

একফালি এলানে জরিন সুতোলে পথ। 

পরাগ ঢেউয়ে গন্ধবহ'র রাজ। 

কারোরই কিন্তু ছিল না, একটুও মত। 

মরুৎ তবু পথের প্রেমিক আজ।

খেলা ভাঙন, স্বপ্নে সুর্খ সিঁথির আখরি রুখসত। স্মরণে এল, কবিতা লিখছে। বেওকুফ অওরত।

সখী, মাথা খা! এইবার বাটেই চল না।


“Dard aayega dabbay paon liye surkh chiragh.” – Faiz Ahmed Faiz


১৬


– স্বপ্ন এক্তিয়ার ভুক্তির চারপাশটা ঘষা কাচে গড়া হয়। অতলান্ত তালশাঁস রঙা জলে জেগে ওঠে এক বা একাধিক প্রতিভাস। চৌকো চৌকো এক সার গেঁজে ওঠা কোটরে একের পর এক অ্যালবাম খসা নস্য-হলুদ পাতা মনভাঙা শুয়ে থাকে পাশ ফেরা।

– স্বপ্ন ওদের কাতরে কাতরে ডাকে, হাটকায়, খোঁজে।

– ওরা কেবল বেভুল ওড়ে, পড়ে এবং হঠাৎই হারিয়ে যায়। এ চলাচলে কখনো হয়তোবা একরকম নিশি টানে বুকের কোল ঘেঁষে বসে এবং নিয়তি টানে আঙুলের কোল গলে মিলিয়ে যায়। বুড়ো সেগুন পাতা ঝড়ের জাড্য ধর্ম বইবে এমনই ধারা।

– চোখ এদের খিঁমচে খিঁমচে ধরে, আগলায়, জ্বলে।

– অমোঘ মোহ। অমোঘতর মায়া। অমোঘতম মৃত্যু।

– তবে, প্রেম?

– চৈতালি ঝাপটে বুড়ির চুল।


১৭


– আজ তোকে আমি একটা গল্প বলি পূর্ণা?

বাঁচারা বসত করে।

নদীর উপর শিকড় হীন সংসার গড়ে নাজু নাইয়ার সম্বৎসরের জীবন। প্রতিপলে গতিময় প্রতিপলে স্থিতিশীল।

ভাত বাড়ে নাজু বউ, গরম ভাত, চূড়োয় ফিকে বেগুনি গোলা সাদাটে পেটের পেঁয়াজ একটি।

অল্প অল্প দোলে।

কাঁচা মরিচের চিকিমিকি সবুজ মতো হিলহিলে শরীর পায়ে নিয়ে থালা ভরা ভাতের রাশি দোলে, সীমের চ্যাপ্টা ঘষা সবজেটে মতো টুকরো টাকরা গায়ে নিয়ে টাটকানি মাছের ঝোলের বাটি দোলে, স্বামীর পরিতৃপ্ত মুখে গরাস গেলা দেখে বউয়ের বুক সেই সে দূরের পাড় ঘেঁষাঘেঁষি ক্ষেতের মতো গাঢ় সবুজাভ এক ধীরা খুশাল দুলুনিতে থিতু হয়। ঈষৎ মেটেল গাঙের জলের ঘটিতে সেই মিঠেল মুখখানি দোল খায়।

লাজানিয়া চাউনি স্বামীর থেকে ঘুরিয়ে নাইয়ার আদরিণী বউ চোখ বসায় আদুল কচিটার আদুরে মুখে।

খোকা শুয়ে থাকে ত্যানা ন্যাকড়ার ওমে গুমসুম। কচি পাকা ধান রঙা মাজায় কালো কারে গাঁথা জালের কাঠি নাভীর নিচটায় শুয়ে থাকে ওরই মতো গুটিসুটি। পাহারাদার সে। খোকার বাঁচন আর জ্বীন-পরী- বুরি নজরের চোখের মাঝে দেওয়াল তোলে। সে দেওয়ালও দোলে খুবসম্ভব। খোকা হাঁচি দেয় ঘুমঝিলে ডুবন্ত। নড়ে ওঠে জালের কাঠি।

হেই সামাল!

বাতাসের গতিক ঠাওরায় নাইয়া। ভোরের গাঙের বুক জুড়ে ভীড় করেছে ফুটন্ত ভাতের হাঁড়ির মুখে উড়তে থাকা ভাপেরা। নজর চলেনা বেশী তক্। কিন্তু হাত জড়ো করার তো উপায় নেই। বিবিবাচ্চা এক জাহান ভরসায় বুকজুড়ে মুখ ডুবিয়ে। মাছ ধরতেই হবে, নাও বাইতেই হবে। মহাজনদের হাঁ তে কামটের দাঁত। ভাশলে জাল কাঁধে অনুভবি মন বৈঠা আঁকড়ায়। 

হেই সামাল!

– এবারে আমার গল্পটা শোন রণ।

ব্যথারা বসত করে।

পাড়ের উপর শিকড় গেঁথে সংসার ঠ্যালে দুলি বাগদীর দিবানিশির যাপন।

প্রতিপলে যন্ত্রণাবদ্ধ প্রতিপলে ভাঙচুর।

গাঙের ঘাটে ঘড়া ভরে দুলি বউ। পেতলের সোনাল মাজা ঘড়া গবগবিয়ে জল গেলে। ঘাটপাড়ের ঘোড়া নিমের কাঁটায় দুলি বউ কঁকিয়ে কাৎরিয়ে ফোস্কা গালে।

অল্প অল্প ফোলে।

চাকা চাকা গাঢ় অবমাননা মত রক্তালু দাগ বসা পিঠ ফোঁপানিতে ফোলে। সূর্য বসা পাটের মতো বিষন্ন রক্তিম দাগী চোখের উঠোন যাতনায় ফোলে। জমাট আঁধারি বুকটা হাহাকারে গলাচেরার মতো রক্তমুঠি পেষণে ফোলে। ঘাটের পৈঠায় হাঁটু মুড়ে বসে দুলি বউ ডুকরে ডুকরে ফোলে। ঈষৎ মেটেল গাঙের জলের ঢেউ আরশিতে সেই মেঘেল মুখখানি ফুলে ওঠে।

দুখিয়ারী চাউনি কোলের থেকে তুলে বাগদীর অভাগিনী বউ চোখ রাখে ঘ্যানঘ্যানে আকাশের নিস্তেজ সূর্যের মুখে। রক্তাল্পতার গ্রাসে রাহুগ্রস্থ ক্ষেত খামার নদী মাঠ গ্রাম। সবেরই উপরে ছাই রঙা অস্পষ্টতার পর্দা। ঘোলাটে ঘষা কাঁচের বিষন্ন দেওয়াল উঠেছে যেন চোখ আর চরাচরের মাঝে। সে দেওয়ালও ফোলে খুবসম্ভব। দুলি বউয়ের কোঁকানি আছড়ায় অদৃষ্টের আখরে। উত্তরে হাওয়া ঘা খেয়ে ঘাই মারে।

হেই সামাল!

এই গাঙেরই দূরের বাঁকে এক গঞ্জে জন খাটে বাগদী। আজ ডুব দিয়েই ভিতরে জানান পেলো জলে বড়ো কান্নার মিশেল। বুকজলে দাঁড়িয়ে নিজের গাঁয়ের পানে চেয়ে রইলো আবছা দৃষ্টিতে। বউটার বড়ো মুখচাপা, মা আর বোনের বড়ো মুখনাড়া স্বভাব। আন্দাজ করতে চাইলো ইদানিং চ্যালাকাঠের কটা ঘা রোজ বরাদ্দ মেয়েটার। স্বামী যথেষ্ট রোজগেরে না হলে একত্তর থাকা সংসারে বউয়ের বড্ড খোয়ার। শরীর শক্ত হয়ে যায়। গামছা কাঁকালে মরণপণ মন আজ আরোও দশ বস্তা বেশী বওয়ার কসম আঁকড়ায়।

হেই সামাল!

– চল আমাদের গল্পটা লিখি।

নদী সবটা দ্যাখে। নদী সমস্তটা জানে। এর নাও ঘরের দাওয়ায় ওর ভিত ঘরের চৌকাঠে খলবলিয়ে বলে যায় একই বুলি। 

হেই সামাল সামাল।

সকাল আসবেই!

– এটা হলেও হতে পারত রণ আমাদের গল্প, কিন্তু...

– হতেও তো পারে পূর্ণা…


আশারা বসত করে।


১৮


– এক একটা দুপুরের পেটে―

বড্ড ঘোলাটে বিকেল জন্মায়। 

নিঝুম অপরাজিতারা লেপ্টে যায়― 

যুদ্ধরত কণ্ঠমণির চূড়ায়। 

চরাচরে আলো মেলে―

ঝুল-আকর্ষে দেওয়ালগিরির শিখায়। 

পুরোনো ন্যাতার ঝুরি লেগে থাকে আকাশ ব্যেপে।

ফাঁকে ফোঁকরে উঁকি দেয় পরাহত অতলান্ত।

ডাঁটভাঙা চশমা ও ছাতা জল মাপে, এড়ায়। 

নীল কেবল নষ্টপরীর জামায় থাকে না রণজয়।

কষ্টস্বরের প্রতিটি পাঁকে, ঢোকের প্রতি বাঁকে, 

তাকে সযত্নে গিলতে হয়।


১৯


– পার্চমেন্ট রঙের মুখ দেখলে তক্ষুণি আঁজলা ভরে আবির নিয়ে মাখিয়ে দিয়ো না ছুটে গিয়ে।

সহ্য ক্ষমতা ডিঙিয়ে যেতে পারে।

শোননি কি লাদাখ থেকে নামার পরে ধ্বস্ত সেনানীকে তক্ষুণি বাড়ি ফেরানো হয় না?

বোধের মাত্রা হারিয়ে যেতে পারে।

কোলাপস করে যাবে। আশঙ্কা।

তার চারটে আঙুল আলতো ধরে দুজনায় বোসো কোনও প্রাচীন ঘাটে।

নবীন সম্পর্ক গড়তে ওর জুড়ি কেউ নেই। 

তারই কোশে কিছুটা ফাগ রেখে বোলো তোমায় রাঙিয়ে দিতে। 

ছেঁড়া বিশ্বাস জুড়তে এর পারা আর নেই। 

সেটেলড হয়ে যাবে। আশা। 

আক্রান্তের সংখ্যা এখন দুই।

এর পরপরই বৃষ্টি নামবে। নিশ্চিত।

অনন্ত আকাঙ্ক্ষিত অসুখটার পদবী বৃষ্টি।


২০


– যে শোক কোনকালেই উপলব্ধি করিনি আমি তারজন্য আশরীর ছিল পিপাসা তোমার।

– যে ব্যথা কোনকালেই অনুভব করনি তুমি তারজন্য আনখশির ছিল তেষ্টা আমার।

– যে শোক কোনকালে কাঙ্ক্ষিত ছিল, আজ তাতেই চূর্ণ আমি। যে ব্যথা কোনকালে ঈপ্সিত ছিল, আজ তাতেই দীর্ণ তুমি।

– চূর্ণী, আমরা কি কোনদিনই অমূলক আলোয় ভাসিনি? দীর্ণা, আমরা কি কোনদিনই অমোঘ আঘাতে হাসিনি? ভাসিনী, সত্য বল।

– আমরা কি কোনদিনও ভালই বাসিনি?


২১


– তোমার শহরে মেঘ বিছালো অভিমানী যে আকাশ,

আমার ছাদেতে বৃষ্টিরা তার দোসর থেকেই ঝরে।

– তোমার আলসে ভিজিয়ে চুপ যে বোকার হদ্দ কাক,

আমার বাগানে ঝাউগাছ থেকে তার জোড়াটাই পড়ে।

– তোমার টেবিল উলটপালট কাগজ কবিতা উড়লো,

আমার একলা সারেঙ্গী জানো সেই ছন্দেই বাজছে।

– তুমি না চাইতে যে মনেপড়া তোমায় জড়িয়ে বাঁচলো,

আমার হাসনুহানার মিঠাস তারি সোহাগে সাজছে।

– আমরা নাকি ভুলে যাবো সবটা এমনি এমনি। 

– অতোটাই সোজা বুঝি? 

পেরেছো? 

– পারিনি, পারোনি।


২২


– তোকে একটা ফোন করি, কাল?

আ-বিচ্ছেদ জমা দিস্তে দিস্তে অভিমান বলছে,―

"আমায় উপুড় চুপুড় ঢাল"।

– আজ সায়াহ্ন বারিষ মাখালো, জানিস?

অসহ্য আদরে পুড়িয়ে লোমকূপ বললো,―

"এমনই আমার সোহাগ-জলে বাঁচিস"।

– ইদানিং তোর কোথায় যেন থাকা?

সেখানেও কি এমনই কাউকে জড়িয়ে বলবি,―

"আজ আঁকা মানে তোর বুকে মুখ রাখা"।

– গহীন ভাসছে আ-শরীর এক নোনতা জলজ বিন্দু,

দরদী গাইছে―

"ঠিকানা না রেখে ভালোই করেছো বন্ধু"।


২৩


– জানিস পূর্ণা, কাল কী হল!

দরজা খোলো জানলা খোলো দেরাজ খোলো আলনা খোলো আমরা হাজির ডাক পেয়েছি।

নষ্ট জীবন নষ্ট যাপন নষ্ট প্রেমের স্পষ্ট কারণ আমরা ঠিকই টের পেয়েছি।

ঘুণপোকাদের সেকি হাঁকাহাঁকি!

রাশি রাশি অগুনতি ইকড়িমিকড়ি পোকাগুলো কোলাপসিবল ঝাঁকাচ্ছে।

দখল নেবে একদা প্রেমের বিচরণক্ষেত্র জুড়ে নবজন্মা বন্ধ্যা চরের। 

আস্তানা গাড়বে গোটা দ্বৈত-নিয়তির ভবিতব্যে।

ক্ষয়িষ্ণু সম্পর্কের ক্ষণভঙ্গুর হাড়কখানা কড়মড়িয়ে ধুলোয় মেশাবে। 

দিবারাত্রি দশদিকে আচ্ছন্ন করবে মোনোটোনাস কামড়ানি ধ্বনি।

কড়কড় কড়কড় শেষ কর শেষ কর।

– কী আশ্চর্য রণ!

সব সব দ্বার দুয়ার এঁটেই তো রেখেছিলাম,

বিগলিত ইমোটিকনও টাঙিয়ে রেখেছিলাম,

আভ্যন্তরীণ আবিলতা বিক্ষুব্ধ বোঝাপড়া

কফিনশীতল কথোপকথন আর

ওই দিনান্তের দ্বৈরথ টের পেল কি করে?

দরজা খোলো জানলা খোলো দেরাজ খোলো আলনা খোলো আমরা হাজির ডাক পেয়েছি।

ছিন্ন জোড়ের ভিন্ন ডোরের মালার গোড়ের পচন-গন্ধি গোটাদুয়েক লাশ পেয়েছি।

– চল, দুজনেই যাই, সম্পর্কিত রোজনামচার প্রেতপিণ্ডদান করে আসি।

– গাঙে দ্বিতীয় ডুব দিতে যেতেই দেখলাম গোলাপী খামে চড়ে সমুদ্রনীল কতগুলো কথা উড়ে উড়ে যাচ্ছে ভেজা খোঁপার আড় ভেঙে।

– আচ্ছা, তুমি কি সবসময়েই এমন সুন্দর?

– নাহ, তুমি দেখবে মনস্থির করলেই একটা বাচ্চা পরী এসে গালে ঠোঁটে সুন্দর মাখিয়ে দিয়ে যায়।


২৪


– আজ তোকে ভেতরের দুটো কটা কথা বলতে ইচ্ছে করছে রণজয়। 

পাঁজরের গর্ভের এক্কেবারে গহীন কুঠুরির গলা বেয়ে উঠে আসা শব্দেরা চাইছে তোকে বলতে,―

প্রেমের জন্য সাজিয়েছিল উঠোন ভরা আলোর গান, নষ্ট দুপুর চিবিয়ে খেল ভালোবাসার অপুষ্ট ধান।

দাওয়ার বুকে মেলা ছিল ভরসা ফোঁড়ের শেতলপাটি, পলি ভেবে গড়তে পুতুল ধ্যুর চুরচুর বেলে মাটি।

প্রেমের জন্য গুছিয়েছিল ভর ভরন্ত হৃদয় তূণ,

নিমেষ ভাঙন দাঁতে কাটল ছিন্নভিন্ন ধনুর্গুণ।

নদীর বাঁকে হয়তো উধাও মান্দাসে লীন নীলাভ লাশ,

পীতাম্বর আর নীলাম্বরী মরণ পেঁচায় আজন্ম পাশ।

বসন্ত এলে খলখলিয়ে দান ছোঁড়ে মৌত, রক্তবীজ,

পলাশ শিমূল কৃষ্ণচূড়ায় আভরণ তার হৃদয়-সিজ।

ক্ষীণবীজী ক্ষণজীবী আশনাই ডরা ছাপোষা লোক,

মাকু চলন নাগর-দোলায় ভালবাসাই পোক্ত হোক।


২৫


– তোর চিঠি পেয়েছি সুপূর্ণা। আসলে কী জানিস,―

ব্যর্থ প্রেম জড়িয়ে আছে হুতাশ বিকেলের আঙুলে।

ফণিমনসার কুঁড়ি মেখে আছে উদগ্র নিশির ডাক।

প্রান্ত-ঠাঁই নিমফুলে সান্ত্বনার খোঁজ উদ্বাস্তু আলকুশি বীজের। 

হিংসুক হাগড়া হাতায় নিরিবিলি গর্ভ পাতে মধুমেওয়া ফল।

খুড়াকাঁটা স্পর্শে যন্ত্রণাদীর্ণ প্রত্যেকেই আজ মনমরা নক্ষত্র ছুঁয়ে, এক একটি সন্ধ্যাগাছ।


২৬


– আমি যখন বলব প্রতিটি হৃদ-নক্ষত্রের মৃত্যু-নিঃশ্বাস মুহূর্তটাকে,―

কড়া নৈঃশব্দ্য আগাগোড়া ঘের-বন্দী করে রাখে; 

তুমি কিন্তু বুঝে নিয়ো তুমুল ভাঙচুরের গলা বাওয়া ডাক উঠলেও, 

তাকে টিপে ধরে রাখে আত্মগ্লানির ক্ষরণ!

কণ্ঠায় বিশ্বাসের কষ ঝরায় না দেখা ছুরির ফলা। কণ্ঠীটায় অপ্রেমের রঙ ধরায় একটা অদৃশ্য ক্ষুর।।

– সমস্যা হল ঐ ক্ষুর-ক্ষত গলগলিয়ে উথলোয় যে অপ্রেমজ বিস্ময় ঘৃণা ক্ষুব্ধ শাপশাপানি―

সেও তো বেশ তীব্র লালই! 

হ্যাঁ, অবিমিশ্র নয়। 

হিলহিলে লাশ-নীল প্যাঁচানো।

থোকা থোকা ঘেন্না-হলুদ জড়ানো।

তবুও এই এতোখানি লালই তো―

গাঢ় ঘন থকথকে লাল!

– তবে যে সর্বক্ষণ শুনি― 

কেবল প্রেমেরই অবিসংবাদিত অধিকার লাল-এ! 

তাহলে অপ্রেমেও এত প্রেম কেন ডোবালো ঈশ্বর?!

– উত্তর খুঁজতে যাবে? চলো!

– উঁহু, তোমাকে তো সেখেনে নিয়ে যাওয়া চলে না। তুমি বরং গন্ধরাজের পাপড়িতে কীটের পদচিহ্ন খোঁজ।

– জানি আমি আনখশির কতখানি ভুলে গড়া অমানব, তবুও অভিমানিনী, আমাকে ছাড়া একলাটি খুঁজলে কোনও উত্তর কি তোমার কাছে কখনও ধরা দেবে বলে বিশ্বাস করতে পার? 

আজও??


২৭


নিঝুম বারান্দায় কাঠের রেলিং―

অভ্যাসে দুলে চলে রকিং চেয়ার, একটি ফিঙে, 

ঠোঁটে একটি ফড়িং―

পলক জিরিয়ে ফের উড়লো আবার!


দেখেছিলাম…


সন্ধ্যে বিগত ধুবা মেঘলা বিকেলে― 

ফ্যাকাসে সিঁথিতে নেই সৌর পরশ, 

অসর শেষে সাঁঝ তোমাতে তাকালে―

আরশিতে জলছাপ খোদার আরশ!


বুঝেছিলাম...


ক্রমশঃ তলিয়ে যাচ্ছে স্নিগ্ধ মানুষীর দেশ―

উল্লাসী মুখগুলো আদতে অসুখী, 

"পাশে আছি" "ভালোথেকো" শব্দেরা শেষ―

ঘাড় গুঁজে বমি ঢালে সুরজমুখী!


জেনেছিলাম...


সামাল ডাঙাতে ডোবে লখাইয়ের ডিঙা―

ধর্মীয় আগ্রাসনে ধ্বস্ত বেহুলার ঘর, 

কাকলাশ ডিস্কে বাজে রিরংসার শিঙা―

ডুকরে ফুঁপিয়ে ওঠেন আমার ঈশ্বর!


আঁকড়ে ছিলাম...


গাঢ়রক্ত গন্ধমাখা নির্বংশী রাত শুনতে পাচ্ছো?


আমরা চলে গেলাম।



No comments:

Post a Comment