Sunday, December 27, 2020

আনন্দনগরীর সেকাল

 কবিতা লিখতে ভালবাসি কচিকাল থেকেই। 

শব্দের ঝিলমিল ঝঙ্কার আর ছন্দের অবাক করা চলনের মিঠে জাদু গুণ করেছিল। যাহোক কিছু ঘুলিয়ে মিলিয়ে খাড়া করার চেষ্টা করতাম স্কুলের নীচের দিককার ক্লাস থেকেই। বুঝতেই পারছেন সেগুলো কী অদ্ভুতুড়ে দাঁড়াত। (শ্যামলদার শ্যামল চ্যাটার্জী কাছে এর কিছু কিছু নমুনা আছে)। কেউ ফিরেও তাকিয়ে দেখেনি সেসব খ্যাপামির খতিয়ান কিন্তু তাতে লেখার প্রাবল্যে ভাঁটা পড়ত না কারণ একনিষ্ঠ পাঠক দুইজন ছিল আমার। শ্রোতা আরেকজন।

বাবা আর মা। দিদা।

হ্যাঁ, পরের দিকে আমার লেখালেখি ফালাফালা করে দিলেও সেই বয়সে খানিকটা প্রশ্রয়ই দিয়েছে মা। আর বাবা তো চিরকাল "অ্যাঁ? হ্যাঁ, ভাল , ভালোই তো।" ছাড়া কিচ্ছু বলেনি।


তারপর একটা সময় বরাত মাফিক প্রেমপত্র লেখার কাজ শুরু করলাম। অনুভব করতে পারলাম গদ্যের মাধুর্য। লেখার প্রতি ভালবাসা গাঢ়তর হতে লাগল। একসময় বন্ধু হয়ে গেল কাগজ কলম, মন ভাগ করে নিতে থাকল অব্যক্ত অভিব্যক্তি। ফলে নিজেকে ভাল রাখবার জন্য, নিজের সঙ্গে কথা বলবার জন্য আর নিজের ভেতরের চাহিদা মেটাতেই লিখে চলেছি। সই পাতিয়ে নিয়েছি কালি কলম মন এই ত্রিশক্তির সঙ্গে। অন্তরাত্মা জানেন, সেগুলো ছাপার যোগ্য এ আমার কোনওকালেই মনে হয়নি, আজও হয় না। 


এরপর দশ সালে ফেসবুকে এলাম। শ্যামল চট্টোপাধ্যায়, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় Prasenjit Chattopadhyay , শ্রীদীপ চট্টোপাধ্যায় Sridip Chattopadhyay এবং সায়ন্তন গুপ্ত Sayantan Gupta , অলিপ কুণ্ডু Alip Kundu মাসুদুর রহিম বন্ধু হলেন। হইহই করে ইন্ধন জুটলো। শ্যামলদাকে তো কড়ার করে নিতাম নকুড়ের মিষ্টি আনবে, তবে কবিতা পাবে। মনের আনন্দে লিখতাম ফেসবুকে, দশ বার জন পড়তেন। প্রাপ্তি ষোল আনা এতেই মনে করতাম। দস্তুরমত ফেবু লিখিয়ে যাকে বলেন আপনারা। 


ধীরে ধীরে Amitabha Siraj অমিতাভ সিরাজ, রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য সান্যাল Ramkrishna Bhattacharya Sanyal, রূপঙ্কর সরকার রূপঙ্কর সরকার Rupankar Sarkar, রফিকুল ইসলাম Rafiqul Islam, নইমুল হক পারভেজ Naimul Hoque Pervez, সোমমৌলি অধিকারী Som Mauli Adhikary, ব্যোমকেশ মণ্ডল Byomkesh Mondal, গৌতম সরকার Gautam Sarkar সঞ্জয় চক্রবর্তী Sanjoy Chakraborty তন্ময় দে Tanmoy Dey , সমিত মুখোপাধ্যায় Samit Mukherjee এঁদের সঙ্গে পরিচিত হলাম। সম্পর্ক ফেবুর গণ্ডী ছাড়াল। অমিতাভ সিরাজ মিঠুলদা, রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য সান্যাল রামকৃষ্ণ জেঠু, রফিকুল ইসলাম রফিক দাদা, সোম মৌলি অধিকারী সোমদা, সমিত মুখোপাধ্যায় সমিতদা, গৌতম সরকার গৌতমদা, তন্ময় দে মামা, নইমুল হক কেবল পারভেজ হয়ে গিয়েছেন তা বেশ কয়েক বছর হল। সমৃদ্ধ হতে থাকলাম।


সোমদা আর তাপসদাকে Tapas Das পাওয়ার মধ্য দিয়ে আমার কতখানি ঋদ্ধ হওয়া এ কেবল আমিই অনুভব করি।

পেলাম জাহিদ হোসেনকে Zahid Hossain। পৃথিবীর যে প্রান্তেই আমরা দুইজন থাকি না কেন, আমি জানি আমার দাদা সর্বদা পাশে আছেন। প্রতি মুহূর্তে শিখি দাদার থেকে।


এরপর মঞ্চে অবতীর্ণ হলেন সুজয় দাস Sujoy Das। ফেসবুকের ফ্রেন্ডলিস্টে আসা একজন মানুষ কবে যে আমার সত্যিকারের মামু হয়ে গেলেন আজ আর দিনক্ষণ মনে করে বলতে পারি না। সত্যিকারের বন্ধু যাঁর কাছে সব ওগরানো যায়। পেলাম স্বাতী চট্টোপাধ্যায় দাসকে Swati Chattopadhyay Das। খোলা গলায় বলতে পারি ওঁকে আমি আদর্শ মানি। সুজয় মামুর বন্ধু অরিন্দম চক্রবর্তী Arindam Chakravorty হয়ে উঠলেন অরিণ মামু। ভেতর নিঙড়ে কীভাবে কবিতা জন্মায় অরিণ মামু শিখিয়েছে।

এঁদের প্রত্যেকের উৎসাহে ফেবুতে লেখালেখি বাড়ল তো বটেই, আকাশবাণীতেও একাধিক এবং আকর্ষণীয় সব কাজের সুযোগ মিলল। 'বুধ সকালে', 'আসুন বেড়িয়ে যান' ও 'কলকাতার ডায়েরী' তে লিখে বড় আনন্দ পেয়েছি। একেবারেই অজ্ঞ আমাকে সঞ্জয়দা Sanjay Chatterjee ও রবিনদার নিঃস্বার্থ সাহায্য ভুলব না। নিজের লেখা নিজেই প্রথম রেকর্ড করবার দিনটা তো আমার কাছে অতুলনীয় আবেগের।


শমী মজুমদারকে Shomi Mazumder পেলাম। বন্ধুতা শব্দের অনিন্দ্য অনুরণন। এক্কেবারে মুশকিল আসান এবং একই সঙ্গে আমার সিধু জ্যাঠাও বটে। হেন বিষয় নেই যার উপর ওঁর পড়াশোনা নেই। তাছাড়া ওঁর উপরে যে দাবী ও অত্যাচার আমি চালাই, এ জীবনে কারোর উপরে চালাইনি।


ধীরে ধীরে রামকৃষ্ণ জেঠুর আগ্রহে নুনেতে ভাতেতে-র তৃতীয় খণ্ডে লিখলাম কড়া পানীয় নিয়ে, সুদীপদার Sudip Bhattacharyya আগ্রহে পারাপার-এ লিখলাম কবিতা। এদিক সেদিক এপার ওপারে লেখা হল কিছু কবিতা গল্প রম্য রচনা ভ্রমণ বৃত্তান্ত। 

সুদীপদারই আগ্রহে আঠারো সাল থেকে এইবার অবধি কলকাতা বইমেলায় বলবার সুযোগ পেলাম। ইদানীং জেঠুর যোগাযোগেই বৈদ্যুতিন মাধ্যমে বকবক করছি মাঝে মাঝেই।

সবই হল, কিন্তু নিজেকে পাতি ফেবু লিখিয়ে ছাড়া অন্য কিছু ভাববার সাহস জোটেনি কখনও, ইচ্ছেও হয়নি। বেশ ছিলাম এসব নিয়ে। 


ব্যক্তিগত জীবনে তুমুল ওঠাপড়া চললেও, গায়ে যতটা কম লাগে, কলম যেন না থামে, তারই চেষ্টা করে গিয়েছেন এঁরা। আমিও সম্মান রাখার চেষ্টা করেছি।


এ বছরের শুরুর মাস দুই তিন পরে সুদীপদাই ফের উসকে দিল কলকাতা নিয়ে লেখালেখির খেয়াল। ছাপা হবে। খানিকটা তো ছিলই আকাশবাণীর দৌলতে, গুছিয়ে বসলাম অক্ষরের ক্যালাইডোস্কোপ আরও কতটা কী দেখায় সেটা লিখতে। প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় Prasun Bandopadhyay সহায়তা করলেন সার্বিক ভাবেই।

লেখা তো হল কিন্তু ছাপা হবে হবে হয়েও কলেবরের (আমার নয়, বইয়ের) বিভিন্ন জটিলতায় ছাপার প্রক্রিয়া ব্যাহত হল। 

মলাটবন্দী হচ্ছে না এটা নিশ্চিত হওয়ার পরে আমি তো যথা পূর্বম ফেবুতেই দিয়ে দেব যা লিখেছি এমনটা স্থির করলাম। অলক্ষ্যে কলকাঠি নাড়লেন কপালেশ্বর। আমারই এক দাদার সূত্রে গাঙচিল প্রকাশনার অধীর বাবুর Adhir Biswas সঙ্গে কথাবার্তা শুরু হল। প্রচ্ছদের দায়িত্ব এক কথায় নিয়ে নিল আমার অন্যতম ঈশ্বর বিশ্ব মামার Biswanath Bandyopadhyay ভাগ্নী ছেলেবেলার বন্ধু মামুনের Suchismitam Mukherjee ভাই, আমার ভ্রাতৃসম বুবুন Pritam Kanjilal।

এই সমষ্টির মিলিত ফলশ্রুতি হল : 

"আনন্দনগরীর সেকাল"।


স্পষ্ট বলে রাখি, সর্বাঙ্গসুন্দর হওয়া অসম্ভব কারণ আমার অজস্র ত্রুটিবিচ্যুতি। আপনারা বইটি পড়ে যদি সেই ত্রুটিগুলোই সামনে এনে দেন, শুধরে দেন, সবিশেষ কৃতজ্ঞ থাকব।


ভাল হোক।


তোমার সঙ্গে

 তোমার সঙ্গে যেইদিন আমার প্রথম দেখাটা হল,

সিঁড়ির মুখে ওঠার পথে আঁধার খানিক ছিল।

অস্পষ্টতায় এগিয়ে যাওয়া পল কয়েক নিল।

তারপরেতে দিঠির আরাম বড় সহজ আলো।

দাঁড়িয়েছিলে সিঁড়ির মাথায় তিলেক ক্ষণই বল,

ত্বরিত পায়ে নেমে এলে হাসিতে ঝলোমলো।

মাঝামাঝিতে মুখোমুখি বড্ড নিজের ভেল।

হঠাৎ আপন ঠাঁই মিলেছে এমন ঠাহর গেল।

"এসেই যখন পড়লে সাঁঝে, হাঁটবে পাশে? চল"।


তোমার সঙ্গে যেইদিন আমার প্রথম দেখাটা হল,

এখন থেকে তা অযুত নিযুত আগামী বছর ক'ল।

নাই বা গেলে

 বেশি দূর যেয়ো না, বুঝলে?

ছলাৎ ছল আড়চাউনি দিনমান পেরিয়ে, ছলছল চেয়ে থাকা শঙ্খালি সাঁঝ। 

বেশি দূর নাই বা গেলে।

টালিঘরের ভেতরে

গাঢ় নাভী থেকে উঠে আসে সেইই কাঁঠালচাঁপার গন্ধ। 

খসখসে, বহুদিন মরে ভূত মানিব্যাগের খাঁজে। 

টালিঘরের বাইরে

কাঁচা নালা থেকে উঠে আসে সেইই ভালো বমির ছন্দ।

করকরে, বহুদিন খসে প্রেত কলঘরের মেঝেয়। 

বেশি দূর যেয়ো না, বুঝলে?

গরগরে কলঙ্ক-রাগ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে, টলটল গণ্ডি কাটা ইমদাদী বাজ। 

বেশি দূর নাই বা গেলে ...


থকথকে রক্ত মেখে ছেতরে আছে কালাচের ত্বক।

শাঁখামুটি ইনিয়ে বিনিয়ে পেঁচাচ্ছে কেবল।

কী হয়! কী হয়!

 সাঁঝদিয়াই অন্ধ-মণিটিকে সাঁটিয়ে দিয়ে গেছে রাত চাদরে। সবজেটে-নীল বিষ লালায় মাখিয়ে। 

জানখসা ঠাউরেছে এরে সেই রঙিলা, বেল্লিক খেয়াল। 


দিনমানের সোনাল দিঠিটিকে খুবলে খেয়ে গেছে এক বাদুড়ে। এনামেল সানকিটা জিহ্বায় কাঁকিয়ে। 

এ খলিফাও দ্যাখ সেঁটে আছে বিলকুল, বেহায়া বাচাল। 


কবেকার পাথুরে প্রেতের দল, সারবন্দী লঙরে।

তামামশোধের খেলায় মেতেছে খেঁকুরে সময়। 

চোরাঘাই ঝাপটে চামচিকে সাঁতরাচ্ছে সাগরে। 

নির্বাক সুপুরির চিমসানো ডর, কী হয়! কী হয়!