Saturday, October 8, 2022

সুপূর্ণা রণজয় সিরিজের কবিতা

 ১ 

- জানিস সুপূর্ণা,

কোনো কোনো প্রেম দাঁড় ঝাঁকানি ঘমন্ডী কাকাতুয়া।

ঝুঁটিফুটি বাগিয়ে সে এক দস্তুরমত আড়ম্বরী আশনায়।


- টেকে না...


- একেকটা আবার,

ঝিম লাগা ঝুম দুপুরে আতেঁল গেরেমভারী ঘুঘুটি। 

কিঞ্চিৎ ডাঁয়েবায়ে থুত্নিটি নাচিয়ে ব্যারীটোনে দিল দ্যায়। 


- থাকে না...


- দুচারটে এমন,

হরদম কিচিমিচি সাজুনে গুজুনে ছটফটি টিয়ারা। 

লাফিয়ে চিকরিয়ে এক ঠোঁটেমাখা ভালোবাসা বাতলায়। 


- বোঝে না...


- উফফ! থামবি? 


- কী হলো! বলবি? 


- সবই তোর টেকে না থাকে না আর বোঝেনা!

সুপূর্ণা, কোন বুকেই ভালোবাসা কি বাঁচেনা? 


- জানিস রণজয়,

আরেক সে প্রেম দুই সিধেসাদা গেরস্তঘর চড়াই।

দিনভর ব্যস্ততা সন্ধ্যেয় দুটি বাঁধে সোহাগকে আচঁলায়।


- আজকাল বুঝলি, মোটেও অমনটা হয় না! 


- জানিস ভারী, তোর আসল প্রেমতো সয় না!  


(এভাবে, 

গোধূলি জোগায় কথোপকথন বাঁধুনী,

দুজনায় গড়ে চাপানউতোর এ বেনুনী। 

হটাৎ, 

বিকেলে মিশছে পূরবী নিজেকে রাঙ্গিয়ে,

কনে দেখা আলো তর্ক টা দিলো ডুবিয়ে। )


- ওমন বুকে বাঁধবি সুপূর্ণা? 


- এমন ভালোবাসবি, রণজয়?


২ 

- রণ,

কাল রাত জুড়ে চোখে টায়টায় আকাশ ছিল আমার। 

বিহান বয়সী প্রেম তালাশে ফিরেছি তারাময় অবয়বে। 

সাঝঁ বয়সে এ কি নির্লজ্জ বিচ্যুতি রোজনামচার। 

কালপুরুষে এখনো তৃষ্ণা আকণ্ঠ জাগে অপার্থিবে!  


- পূর্ণা,

কুহকী নিশির ডাকে সাড়া কাল দিলাম অমানিশায়।

আশরীর মেখে নিলাম অশরীরী অতীতচারিতা। 

প্রাকপ্রৌঢ় গুজরান মৌতাতে তরর্ বেহুদা নেশায়। 

অ্যান্ড্রোমিডা আজো চোরাচাউনির সেই অবগুণ্ঠিতা! 

...

- ইশশ্! কতো বেলা হয়ে গেল।


- আহ্! এতো বেলা বয়ে এলো! 

...

(এই যাপনের সমস্তটাই নিষিদ্ধ 

এই যাপন ব্যার্থ প্রণয় নিষিক্ত। 

...

তাই বলে কি অ্যান্ড্রোমিডা 

তাই বলে কি কালপুরুষ

মুছে দেবে রাতের জীয়ন? 

ধ্যাত্ ধুর্ হ্যাটট্ হুউউশশ্!)


৩ 

- ধরে নে পূর্ণা, দ্যাখা হলো  দীর্ঘ অথবা স্বল্প আগামী তে, হয়তোবা কালই। 

কী ঘটবে বলতো তাতে? 

চূড়ান্ত নালেঝোলে মাখা আহাম্মকি কিছু করব আমি, বা তুইই কি? 

দুই অজন্মা হাড়হাভাতে!


- নাহ, মনের শরীর বয়স্কা হয়েছে রণ, নিপুণ শৈল্পিক দক্ষতা জন্মেছে আড়াল করার।

রাগ থেকে রিরংসা, 

ক্ষোভ থেকে ক্ষিপ্ততা, 

প্রেম থেকে অভিমান, 

দাবী থেকে চাহিদা

সব সব সব...

আবডালে রাখি আমি।

মধ্যবিত্ত গৃহস্থের ঢলোঢলো গৃহিনী।

কোয়েলের মোড়কে হাড়গিলে গৃধিনী! 


- (তুই হেঁট মুন্ডু পায়ের নখে মাটি খুঁড়তিস আর আমি ঊর্ধমুন্ডু নারকোল পাতায় লটকানো মেঘের টুকরো গুণতাম।

তবু আমরা পরস্পর কে ছুঁয়েই রইতাম, নির্জলা তৃষ্ণা আর নিস্ফলা অঙ্গীকার আকণ্ঠ ধারণ করতাম, মনে আছে?)


- (তোর লড়ঝড়ে সাইকেলটার মতোই আমাতে একচোখা ছিলি বড়ো, দুর্নিবার একরোখাও। ক্ষীর গুমোরে নাকের পাটা ফুলতো আমার, আবার  ঘাম জমতো তেলোতে তোর দস্যিপনার ডরে। মনে পড়ে?)


- কিছু বললি?


- নাতো?


- তুইকি কিছু?


- নাহ।...


(...ভ্রাম্যভাষ স্তব্ধ।


...ওরা নিশ্চুপের বাক্যালাপে মগ্ন।

সব কথা কি ঠোঁট নেড়ে বলা যায়...)


৪ 

- সব ভিজে যাচ্ছে রণ! সব সব সবটা ভিজছে।


ভোর থেকে দুপুর, আলসে থেকে উঠান, কেয়ারি থেকে আগাছা, বেড়াল থেকে দাঁড়াশ, সাইকেল থেকে ল্যাম্প পোষ্ট, কুমুদিনী থেকে আত্মদীপ

প্রকৃতি ভিজেই চলছে!

অহং থেকে  অভিমান, লালসা থেকে প্রেম, গ্লানি থেকে তৃপ্তি, হাঁটা থেকে পিছুটান, ন্যাকামি থেকে ফুসলানো, ঘৃণা থেকে চাহিদা

পুরুষ ভিজেই চলছে!


সব্বাই মরে যাচ্ছে রণ, আকণ্ঠ মরেই যাচ্ছে।


কি অকুণ্ঠ ভালোলাগায় কি উদ্দাম ভালোবাসায়

তীব্রতম আশ্লেষে বৃষ্টি খিঁমচে 

ভিজতে ভিজতে চুপ্পুর মরণ সব্বার!


আমি যতটা শুকনো ততটাই শুকনো থেকে গেলাম।

আজও। আজকেও।


তুই এলিনা। ...


৫ 

- দিতে পারো ওই এক কুশী কাকচক্ষু মরম জল?

ধ্রুবশুভ্র চন্দনগন্ধী। 

ঠোঁটের কষ ছুঁয়ে নামলো যা এক্ষুনি। 

কথা দিচ্ছি। 

মুহূর্তে বিলিয়ে দেবো অতৃপ্তির আযৌবন অহংকার।

নতজানু পরিতৃপ্ত একান্ত প্রেম হবো। 

একবার।

আরেকবার।

অন্তিমবার। 

 

রুধির তো তীরের পিপাসা মেটায়। 

কিন্তু তৃষ্ণা যে তূণীরেরও থাকে সুপূর্ণা। 

তুই কবে সেটা বুঝবি বল?


৬ 

- নিজেকে শোনা হয়না বহুদিন। 

এঁকে ওঁকে তাঁকে শুনতে এবং বুঝতে আর বুঝতে এবং শুনতে...আর জানতে এবং যুঝতে, 

এই ওই সেই ইত্যবসরের ইত্যাদিগুলোতেই

অনুপল থেকে অনাদি অবধি কাবার।

নাহ্,

আজ আমি পাশটায় শোয়াবো, নিজেকে।

আজ আমি শুনবো শোনাবো , নিজেকে। 


- তারপর ...


- গলা জড়িয়ে ঘুম পাড়াবো, নিজেকে।

ঘুমিয়েছে...


- এরপর 


- ঘুমিয়েছি ভাববো নিজেও। 

মিছিমিছি...

আসলে, সেই সে রাত টা না এলে কি সেই সে ঘুম টা আসতে পারে বা আসতে চায়?

শোনা কিম্বা শোনানোগুলোও কি হয়, 

আদৌ? 


- রাতটা আবার কবে আসবে সুপূর্ণা?


- রাতটা সেবার কবে এসেছিল রণজয়?


৭ 

- আসলে ঘটনাটা হলো এই যে, তোকে খুব করে ভালোবাসি বোঝা ও বোঝানোটা (সাধ কতো!) খানিক খানিক কোনও গতিকে যদিওবা হয়ে উঠলো শেষমেষ, 

কিন্তু 

আদতে বাস্তবটা হলো এই যে, তোকে খুব করে ভালোবাসি বলা ও বলানোটা (স্পর্ধাও হয়!) এতোটুকুও তো শেষ ইস্তক আর হয়ে উঠলো না।

আর 

ইদানীন্তন এটা তো তুই জানিসই (মানিসও!) যে বলাটা কি দুর্বার রকমের অবশ্যপালনীয় দরকার। 


- চোখ খুলে বা চোখ বুঁজে যাই কিছু ছুঁই বা ছুঁয়ে যাক, সমস্তটা আগাপাশতলা বলাটা দারুন জাতের এক সামাজিক (মরণ!) দায়িত্ব ও কর্তব্য।


- এইবার বিবাদ (বাওয়াল?) তো অন্যত্র বন্ধু।

সত্যি বলতে কি বিসম্বাদটা (ক্যাচালটা?) সেখানেই। 


- উথালপাথাল শোকে একলা লেখার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে যখন তোর ভেবে নেওয়া (একশো শতাংশই কি?) জড়িয়ে ধরাটা মনকে (শরীরকে নয়?) দিয়ে থাকি, প্লাবনের পলিমাখা গাঙ আলের খেজুর গাছ হয়ে উঠি।

আমি তো নাচার।  

এমন কোনও তৃপ্তিময় খেজুর গাছের ঠিকানা চলতিতে পেলে শুধোগে যা, বলা না বলা ফিলিংসের কিস্যাগুলো।


- কালচে নীল ভয় মাখা শিরদাঁড়া কোঁকড়ানো ডিভানে অনেক রাতে যখন তোর ধরে নেওয়া (একশো শতাংশই কি?) বুকে মুখ মাথা (নিজেকে নয়?) গুঁজে ঘুমিয়ে পড়ি, মাতৃগর্ভস্থিত নিশ্চিন্ততা ডোবানো আহ্লাদী ভ্রূণ হয়ে উঠি। 

আমি তো নাচার।

এমন কোনও ঘুম জড়ানো ভ্রূণের সাকিন চলতিতে পেলে তাকে শুধোগে যা, বলা না বলা ফিলিংসের কিস্যাগুলো। 


- রণ, সবটা বলা হয়ে উঠলো না রে।

সবটা বলা হয়ে উঠবে না।


- সবটা বলবো না।

বলবোই না। 


- যাক, বেঁচে গেলাম!


৮ 

- নৃশংস বিষণ্ন কাউকে দেখেছিস কখনও সুপূর্ণা?


- কী? 


- এই ধর চর দিগর বিধ্বংসী এক সাগরী ঝঞ্ঝা, তার আগ্রাসনের কর্কশ চিহ্ন ছড়িয়ে, দাজ্জাল তাণ্ডব সেরে চলে গেছে কিছুমাত্র আগে, 

কিছু পরে হয়তো দাঁড়িয়ে আছিস সেই ক্ষোভে ফুঁসে চলা প্রতিস্পর্ধী নদী মোহনার পাশে, 

দেখতে পাবি তাঁকে। 

আবার ধর নোনতা বালিয়াড়িতে এক ইবলিশের বাচ্চা ঢেউ, ব্যাঙের লাখান জিভ বিছিয়ে, নাগাল পাওয়ার পর মুহূর্তে সড়াৎ গিলে ফেলেছে তরতাজা ছেলেটাকে, 

সেক্ষণে দাঁড়িয়ে আছিস সমস্ত বোধ ঘুলিয়ে যাওয়া মায়ের পাশে, 

দেখতে পাবি তাঁকে।  

নাহ, পরাভূতের দিকে চাইলে হবে না। পরাক্রমীর দিকে চাইলেও হবে না। 

খলখল করে ঝাঁপান জোড়া ঢেউ পেরিয়ে চাইতে হবে প্রাত্যহিক রাক্ষুসেপনার ওধারে। 

আত্মপক্ষ সমর্থনের কচকচি সরিয়ে, যেখানে গাঢ় অতি গাঢ় কালচে সবুজ জঙ্গম প্রান্তরেখাগুলি ধারণ করে আছে আদিগন্ত বিস্তৃত এক রাশ পিত্তিরঙ যন্ত্রণা, 

যেখানে প্রতিপল অগণন জমাট পিণ্ড হতে চাইছে লুকোনো অনুশোচনা, সেই পানে চাইবি। 

তবে দেখা যাবে। 


- এত শক্ত কথা আমার বুঝতে ইচ্ছে করছে না রণজয়। সহজ হ। আমার তাড়া আছে। 


- বেশ, তবে নিত্যদিন আঁচড়ে খামচে খোকার দুধ খেয়ে যাওয়া বেড়ালটাকে গর্তে পুঁতে ওজন সমান লবণ জলে ঢালতে যাওয়া খোকার মায়ের চোখের দিকে চেয়ে দেখিস একবার। 

গোক্ষুর যখন মেঠো গুঁড়ো ওড়ায় দৃষ্টি সীমা জুড়ে। 


- ঘন অভিমানী এক নৃশংস বিষণ্ণতা।


- এই তো! বেশ বুঝেছিস খানিক খানিক। এতেই হবে, কিম্বা, যেটুকু বোঝার বাইরে রয়ে গেল সেটুকুর জন্য... নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পারিস। আজ। লাল হলুদের ছোপ ধরা এই নিমন্ত্রণপত্রটি হাতে রেখে। কেমন? 


- রণ!  


- মনকে ছুঁয়ে যে মিথ্যে বলা যায়না রে পাগলী!



রোগা নদীটা সাঁঝ গড়ালেই রামধনু রঙ রেশম শাড়ি আজও পরে। 

কতকাল হয়ে গেল বল দেখি, কাছাকাছি বসে থাকিনা জল-ছুঁই ঘাটের পৈঠায়। 

অনিন্দ্য নৈঃশব্দ্য। 


চিলতে আকাশটা আলো দেখলেই তুঁতে চন্দন জামেওয়ার শাল আজও জড়ায়। 

কতযুগ পার হল ভেবে দেখ, পাশাপাশি হেঁটে পেরোই না ভোর-ছুঁই সাঁকোর জমি।

অলঙ্ঘ্য নৈকট্য। 

...


কিন্তু এটা তো তুমি মানবে বল, 

আমরা তো কোনও এককালে এসবই করতুম কেবল। 

খুব রকমেই করতুম, কি না? 


মনে পড়ে? আমারই কি পড়ে আদৌ? 

...


আজকাল কেবল একটা বিরাট চাদর পেঁচিয়ে প্রেতের মতন চলাফেরা করে থাকি।  

বড্ড ভারী ধরণের কালচে রঙ সেটার।

নাকটা কেবল বেরিয়ে আসে। আরও ভারী গন্ধ টানে। 

ঘন জমাট অভিমান। 

অভেদ্য। অচ্ছেদ্য। 

...


আরেকটি সত্য গন্ধেরও ঝাপটা টের পাই, 

অল্পে অল্পে খুইয়ে ফেলছি আমাদের দামী সকলটুকু। 

সামান্য হলেও পাচ্ছ নিশ্চয়, নয়? 


বোঝ তুমি? আমিই কি বুঝি আদৌ?


১০


অভিসারের রং জানো কি? 

হ্যাঁ। 

বলো তো কী ?

নীল।


কোনও কোনও আগামীর পথ পাহাড়ি নদীর মত।

তার আঁকেবাঁকে অজস্র শামুক ঝিনুক বাড়ি থাকে, এ নিশ্চয় জানো?

হ্যাঁ। 

দ্বার খোলা নেই কেবল ঘুলঘুলি হাট করে রাখা। 

পথিকের প্রয়াস সর্পিল চলনে বিপ্রতীপ সহজ গতি আঁকড়ে, এও নিশ্চয় জানো?

হ্যাঁ। 

পথের শেষের খবরাখবর কিছু কি রাখো?

না। 

আমি বলি শোনো -

শেষে একটা পানিশঙ্খ ঘর থাকে।

কোনও একদিন শ্রান্ত সাঁঝের বেলা সেখানে চলে যেয়ো খুঁড়িয়েই সই, কেমন?

পিয়াস মিটিয়ে এসো।

...

স্রোতস্বিনী ঝামর ঝামর চলে, খলখলিয়ে বলে। 

তার গমকে খাদ চড়া উপত্যকায় সে বিষম কানাকানি, এ নিশ্চয় জানো? 

হ্যাঁ। 

যোবনবতী পথচলতি ঝোরার ডাকে মিতালি পাতায়। 

একবগ্গার মত ছুট দেয় সঙ্গ-মনের সাথে একাঙ্গী তীর্থে, এও নিশ্চয় জানো? 

হ্যাঁ। 

মোহনাকে সঙ্গম বলে না, এর ব্যাখ্যা কি রাখো?

না। 

আমি বলি শোন -

সমুদ্দুরের এতোল বেতোল চিরকালের।  

পৃথুলা গজগামিনীর নিয়তিনির্দিষ্ট নিঃশর্ত আত্মনিবেদনে কি ঝাপটানি আশ্লেষ থাকে? 

নদীর বয়স হয়ে যায় যে।


যন্ত্রণার রং জানো কি?

না। 

বলি, কী?

...

আমি বলি, 

নীল।


তুমি কাঁদছ?


১১


- ঘোর বর্ষার ঠিক আগে আগে কখনো কখনো এমন হয়, কোথাও কিচ্ছুটি নেই, ফকফকা আলো, হঠাৎ গুড়ুম গাড়ুম শুরু হয়। প্রথমেই তোদের সেগুন গাছের উপরেই যে শুরুটা হয় বা আমাদের নিমগাছখানার মাথায়, তা কিন্তু নয়।

বুঝলি?


- হুম।


- বহু, ধর না কেন বেশ দূর থেকে গড়াতে গড়াতে আসে আওয়াজখানা। চকমিলানো শানের মেঝেয় ভারী নোড়া গড়াচ্ছে যেন একখান। এই এদিক তো এই সেদিক, এই সেদিক তো এই আরেকদিক। হ্যাঁ, বুকের মধ্যেও। 

শুনলি?


- হুম।


- তারপর আওয়াজের জোর বাড়ে। বেশ বাড়ে। যাকে বলে সত্যি সত্যি বাজখাই। একসময় মনে হয় চিরে ছিঁড়ে ফেঁড়ে দিচ্ছে এধার থেকে ওধার, গোটা আকাশ। সঙ্গে নীল খুব নীল সরু সরু আলোর চাবুক। সপাং সপাং পড়ে। যেখানেই পড়ে, আকাশটা গোলাপি হয়ে যায়। 

দেখলি?


- হুম।


- আমার কী মনে হয় জানিস, মেঘের সঙ্গে মেঘুনির সে বড় রকম ঝগড়া হয়। মেঘুনি করে কী, প্রথমে দোর দেয়। তখন তো দাওয়ায় বসে বিরাট তড়পায় মেঘমামা। হা পা ছুঁড়ে ছুঁড়ে সে ভয়ানক হম্বিতম্বি যারে বলে আর কী। 

বুঝলি?


- হুম।


- হঠাৎ সে মেঘুনি খিল খুলে ফস বলতে ঘরের বার হয়ে যায় ওই হালুম হুলুমের মাঝেই। আর তো তারে পায় না মেঘবাবাজি। খিড়কি সদর আদাড়ে বাদাড়ে না, নেই। 

শুনলি?


- হুম।


- এইবার আর যায় কোথায়! এ তল্লাটে সে তল্লাটে খুঁজে বেড়ায় তারে বোকার হদ্দ মেঘটা। বড় হামবড়াই কি না! পায় না, পায় না, কিছুতেই পায় না। রাগে ক্ষোভে অন্ধ হয়ে খোঁজে। ভেতরে ভেতরে হারানোর ভয় যন্ত্রনা দ্বিগুণ করে, নীল খুব নীল সে ব্যথা। যেখানটায় হয়, সব রক্ত সেখানে ছোটে, তাইতেই তো গোলাপি বর্ণ হয়ে পারে। 

দেখলি?


- হুম।


- তারপর যখন আর কিছুতেই পায় না, পাবার আশখানা ছাড়ে না। ওটারে বুকের এপাশ ওপাশ জড়ায়ে কাঁদে। খুব কাঁদে। প্রথমে হাউহাউ করে কাঁদে। এরপর ঘ্যান ঘ্যান করে কাঁদতেই চলে কাঁদতেই চলে...গড়িয়ে চলে কেঁদে চলে...কেঁদে চলে গড়িয়ে চলে...নুলো তো, খঞ্জও। মেঘুনি ছাড়া চলে, বল? 

শোন না সুপূর্ণা তাই বলছিলাম কী ঈ ঈ...


- বাড়ি যা রণজয়। 


.….....


আশ্চর্য তো! অমন সুন্দর ফুলদানিটা আছড়ে ভাঙলি কেন এভাবে! উফঃ!


১২


– যখন সন্ধে-প্লাবন বৃষ্টি ধরে আসে, রাত তিন কাঠি জড়োর দিকে পা চালায়, পিচ্ছিল গলিপথে পা চালাই আমিও। সরকারি কামিনী গাছের পাশ দিয়ে চিলেকোঠায় ফিরি নিজেকে সেদিনের মত যথেচ্ছ বিকিয়ে। জো হুজুরে জাবনা জুগিয়ে জুগিয়ে মাথাটা সেসময় বিলকুল ফাঁকা চাড়ি। কামিনী গন্ধ তো বড্ড ছিনাল, গায়ে এলানী, তক্কে তক্কে থাকে চাড়ির ডাব্বাটা বাগে পেলেই নিজেকে ঠেসে পুরে দেওয়ার। সবটা জুড়ে রাজ করবেন বেহায়া গন্ধবতী। কিন্তু বাদ সাধে একটা রয়ে রয়ে ডুকরে ওঠা ডাক।


– কীসের সে ডাক?


– সাপের গ্রাসবন্দী ব্যাঙের। 


– কীসের!


– ঠিকই শুনলি।

আচ্ছা, একটা প্রশ্ন করি। ঠিকঠাক উত্তর দে। 

সাপটা গিলতে ভীষণ ব্যস্ত, তোকে কামড়ানোর অবসর তার মিলছে না সে মুহূর্তে, এরম লজিক্যাল কম্ফোর্টে এসে ঘিনঘিনে সরীসৃপটার ভয় সরিয়ে রেখে কখনও দাঁড়িয়ে পড়ে মন দিয়ে শুনেছিস মরণত্রাণের ডাকটা?


– নাহ। শুনিনি। সুখশ্রাব্য নয়।


– আমি শুনে থাকি। সুযোগ পেলেই। কটুশ্রাব্য, অথচ অকাট্য আকর্ষণ। মাদী–মুনিষের পিঠের লম্বে লুকিয়ে পড়া ঘাম ফোঁটা খোঁজার শিরশিরানি।


– ইশ! কোথায় চলেছিস!


– ...খাঁজের ভাঁজে...হা হা হা! শোন না, কেতরে কেতরে ডাকে বুঝলি। 

ডাকটা শুনলেই আমার করোটির ভেতরে একটা ভাইন চারকোল খচখচ দাগ কাটতে থাকে, নাগাড়ে। ধূসর আঁকা তৈরি হয় একখানি। প্রৌঢ়ত্বের খিড়কিদোর ডিঙোচ্ছে এমন এক বাবু তার "বাঁধা"–র প্রসারিত দুই পায়ের পাতার সামনে দাঁড়িয়ে  বেনিয়ানখান খোলার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে, বুক আর ভুঁড়ির ঠিক মাঝ ভাঁজের একটা বিষগিঁট খুলছেই না, কিছুতেই না, কিন্তু কোনও গতিকে খুলে গেলেই অন স্পট জিৎ! নইলে বিষম হেরো। ছড়ানো পায়ের মাঝে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বেচারার ইজ্জত ছড়িয়ে লাট। ব্যাঙটাও তেমনই জানকবুল করছে নিজের বুক পিঠের নুনছালটা সাপের আলটাকরার গোড়ায় খসিয়েও যদি বেরোনো যায় মাড়ির বেড়ার বাইরে, ওই, অন স্পট জিৎ। আন্ডাদত্ত জানডা রক্ষা পায় সে যাত্রা।

পারে না রে। বিষগিঁটটার ইশকুলের খাতার নাম জানিস পূর্ণা? নিয়তি। মাড়ির বেড়াটারও।


– এবারে থাম প্লিজ।


– আরেকটু বাকি, একটুই... এই তুই থাম বললি না, তা সেই ডাকটা থামায়-বলায় অদ্ভুতুড়ে রিদ্মিক বুঝলি। কন্টিন্যুইটি আছে, তবে ঐ থামা চলা মিশিয়ে। আমার কেমন মনে হয় ব্যাঙ বাবাজীবন যম-পেষণের কষ্টটা পেটের কুয়ো থেকে টেনে টেনে গলায় তোলে, খানিক কপিকল ঘোরে, কিছুটা পেতলের বাঁকা বালতি কষ্টগাভীন ওঠে, তবে কণ্ঠায় শব্দ জাগে। ফের টান ফের ওঠা ফের ডাক। হ্যাঁ, তর্কে বলতে পারিস বমিও ওভাবেই ওঠে বটে, তবে চরিত্রে একটু ফারাক আছে। বমি টানা বেশ চড়া। হেঁচকা ওঠে সেটা। এরম ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে নয়। ফলে ওঠারও আওয়াজ মেলে, এরম নিরুচ্চারে জাগাটা নয়। আমার অবশ্য সেটা নয়, এটাই বেশ লাগে শুনতে। শিস ঝিম শিস ঝিম...


– তুই কী ক্রমশ অসুস্থ হয়ে পড়ছিস রণ?


– উঁহু, ক্রমান্বয়ে সুস্থ হচ্ছি বলতে পারিস। চল্লাম গো সই। উঁহু আমি বলছি না, ব্যাঙ বলে যায়। শেষ ডাকে। নাহ, বউকে নয় রে, প্রত্যাখ্যাত প্রেমিকাটিকে। তারপরই সাপটা কোৎ করে গিলে ফেলে। গপ্প মুড়োয়। ওদিকে ডাকটা চিরল চিরল মিশতে থাকে বাতাসের স্রোতে। পৌঁছয় একদা ফিরিয়ে দেওয়া বেঙিটি অবধি? না কি খুঁজে বেড়ায় বেমিশেল জোড়াটিকে। কে জানে...

যে বাতাসে ব্যাঙের বিদায় ডাকের স্বর মেশে সেই বাতাসেই সাপ মেশায় লগ্নডাক আকাঙ্ক্ষী গন্ধ, ভরভরন্ত পেটে তখন তার অপেক্ষা সাপিণীর। প্রতীক্ষা শঙ্খঘোরের। 


– শঙ্খ লাগা দেখেছিস কখনও? দেখবি রণ? দেখবি!...


– ও কী ফুল চুলে বেঁধেছিস রে? নাগচম্পা, নয়? রাশি রাশি বিষাক্ত ফণার মাঝে কেমন নিষ্পাপ শুভ্র শরীর। কিচ্ছুটি জানে না, কিচ্ছুটি বোঝে না। হা হা হা! আমি নেশাতুর পেরিয়ে পেরিয়ে চলি এক ল্যাম্পপোস্ট থেকে আরেক ল্যাম্পপোস্টের আঁধার ভুবন। হাত ছোঁয়া দূরে দাঁড়িয়ে, আসলে অলঙ্ঘ দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকিস তুই কিংবা এই, নাগচম্পা। মাঝের বাতাসে শঙ্খ দেখবি ডাক মিশিয়ে।


– উঁহু, আমি তাকে একে অন্য নামে চিনি। প্রেমনলিনী।


– ত্রৈলোক্যমোহিনী হচ্ছিস পূর্ণা? হিসহিসে, খয়েরি জাদুমুগ্ধতা ছেয়ে বসে তোর কন্ঠমণিতে। নড়তে পারি নে। কোদালে কুড়ালে মেঘে ঝেঁপে বৃষ্টি হয়। জানিস তো? তোকে দেখলেই আমার অমন খণ্ড খণ্ড মেঘ বলে ভ্রম হয় আজকাল। নীলচে ধবল, জমাট গরলধারা। 

এদিকে আয়নায় যাকে দেখি রাতে শোওয়ার আগে, জানলা বেয়ে আসা ল্যাম্পপোস্টের গ্যাজলা হলদে আলোয়, দিন কে দিন কেমন কটকটি ব্যাঙের মত লাগে মাইরি। ঘ্যানর ঘ্যানর করে খুঁচিয়ে চলে :

"দূরে সভা নিকট জল, নিকট সভা রসাতল।"


কামিনী ফুলের গন্ধ ভারী মিষ্টি। সত্যিই।


ক্রমশঃ 

No comments:

Post a Comment