Saturday, October 8, 2022

কামিনী ফুলের গন্ধ

 – যখন সন্ধে-প্লাবন বৃষ্টি ধরে আসে, রাত তিন কাঠি জড়োর দিকে পা চালায়, পিচ্ছিল গলিপথে পা চালাই আমিও। সরকারি কামিনী গাছের পাশ দিয়ে চিলেকোঠায় ফিরি নিজেকে সেদিনের মত যথেচ্ছ বিকিয়ে। জো হুজুরে জাবনা জুগিয়ে জুগিয়ে মাথাটা সেসময় বিলকুল ফাঁকা চাড়ি। কামিনী গন্ধ তো বড্ড ছিনাল, গায়ে এলানী, তক্কে তক্কে থাকে চাড়ির ডাব্বাটা বাগে পেলেই নিজেকে ঠেসে পুরে দেওয়ার। সবটা জুড়ে রাজ করবেন বেহায়া গন্ধবতী। কিন্তু বাদ সাধে একটা রয়ে রয়ে ডুকরে ওঠা ডাক।


– কীসের সে ডাক?


– সাপের গ্রাসবন্দী ব্যাঙের। 


– কীসের!


– ঠিকই শুনলি।

আচ্ছা, একটা প্রশ্ন করি। ঠিকঠাক উত্তর দে। 

সাপটা গিলতে ভীষণ ব্যস্ত, তোকে কামড়ানোর অবসর তার মিলছে না সে মুহূর্তে, এরম লজিক্যাল কম্ফোর্টে এসে ঘিনঘিনে সরীসৃপটার ভয় সরিয়ে রেখে কখনও দাঁড়িয়ে পড়ে মন দিয়ে শুনেছিস মরণত্রাণের ডাকটা?


– নাহ। শুনিনি। সুখশ্রাব্য নয়।


– আমি শুনে থাকি। সুযোগ পেলেই। কটুশ্রাব্য, অথচ অকাট্য আকর্ষণ। মাদী–মুনিষের পিঠের লম্বে লুকিয়ে পড়া ঘাম ফোঁটা খোঁজার শিরশিরানি।


– ইশ! কোথায় চলেছিস!


– ...খাঁজের ভাঁজে...হা হা হা! শোন না, কেতরে কেতরে ডাকে বুঝলি। 

ডাকটা শুনলেই আমার করোটির ভেতরে একটা ভাইন চারকোল খচখচ দাগ কাটতে থাকে, নাগাড়ে। ধূসর আঁকা তৈরি হয় একখানি। প্রৌঢ়ত্বের খিড়কিদোর ডিঙোচ্ছে এমন এক বাবু তার "বাঁধা"–র প্রসারিত দুই পায়ের পাতার সামনে দাঁড়িয়ে  বেনিয়ানখান খোলার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে, বুক আর ভুঁড়ির ঠিক মাঝ ভাঁজের একটা বিষগিঁট খুলছেই না, কিছুতেই না, কিন্তু কোনও গতিকে খুলে গেলেই অন স্পট জিৎ! নইলে বিষম হেরো। ছড়ানো পায়ের মাঝে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বেচারার ইজ্জত ছড়িয়ে লাট। ব্যাঙটাও তেমনই জানকবুল করছে নিজের বুক পিঠের নুনছালটা সাপের আলটাকরার গোড়ায় খসিয়েও যদি বেরোনো যায় মাড়ির বেড়ার বাইরে, ওই, অন স্পট জিৎ। আন্ডাদত্ত জানডা রক্ষা পায় সে যাত্রা।

পারে না রে। বিষগিঁটটার ইশকুলের খাতার নাম জানিস পূর্ণা? নিয়তি। মাড়ির বেড়াটারও।


– এবারে থাম প্লিজ।


– আরেকটু বাকি, একটুই... এই তুই থাম বললি না, তা সেই ডাকটা থামায়-বলায় অদ্ভুতুড়ে রিদ্মিক বুঝলি। কন্টিন্যুইটি আছে, তবে ঐ থামা চলা মিশিয়ে। আমার কেমন মনে হয় ব্যাঙ বাবাজীবন যম-পেষণের কষ্টটা পেটের কুয়ো থেকে টেনে টেনে গলায় তোলে, খানিক কপিকল ঘোরে, কিছুটা পেতলের বাঁকা বালতি কষ্টগাভীন ওঠে, তবে কণ্ঠায় শব্দ জাগে। ফের টান ফের ওঠা ফের ডাক। হ্যাঁ, তর্কে বলতে পারিস বমিও ওভাবেই ওঠে বটে, তবে চরিত্রে একটু ফারাক আছে। বমি টানা বেশ চড়া। হেঁচকা ওঠে সেটা। এরম ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে নয়। ফলে ওঠারও আওয়াজ মেলে, এরম নিরুচ্চারে জাগাটা নয়। আমার অবশ্য সেটা নয়, এটাই বেশ লাগে শুনতে। শিস ঝিম শিস ঝিম...


– তুই কী ক্রমশ অসুস্থ হয়ে পড়ছিস রণ?


– উঁহু, ক্রমান্বয়ে সুস্থ হচ্ছি বলতে পারিস। চল্লাম গো সই। উঁহু আমি বলছি না, ব্যাঙ বলে যায়। শেষ ডাকে। নাহ, বউকে নয় রে, প্রত্যাখ্যাত প্রেমিকাটিকে। তারপরই সাপটা কোৎ করে গিলে ফেলে। গপ্প মুড়োয়। ওদিকে ডাকটা চিরল চিরল মিশতে থাকে বাতাসের স্রোতে। পৌঁছয় একদা ফিরিয়ে দেওয়া বেঙিটি অবধি? না কি খুঁজে বেড়ায় বেমিশেল জোড়াটিকে। কে জানে...

যে বাতাসে ব্যাঙের বিদায় ডাকের স্বর মেশে সেই বাতাসেই সাপ মেশায় লগ্নডাক আকাঙ্ক্ষী গন্ধ, ভরভরন্ত পেটে তখন তার অপেক্ষা সাপিণীর। প্রতীক্ষা শঙ্খঘোরের। 


– শঙ্খ লাগা দেখেছিস কখনও? দেখবি রণ? দেখবি!...


– ও কী ফুল চুলে বেঁধেছিস রে? নাগচম্পা, নয়? রাশি রাশি বিষাক্ত ফণার মাঝে কেমন নিষ্পাপ শুভ্র শরীর। কিচ্ছুটি জানে না, কিচ্ছুটি বোঝে না। হা হা হা! আমি নেশাতুর পেরিয়ে পেরিয়ে চলি এক ল্যাম্পপোস্ট থেকে আরেক ল্যাম্পপোস্টের আঁধার ভুবন। হাত ছোঁয়া দূরে দাঁড়িয়ে, আসলে অলঙ্ঘ দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকিস তুই কিংবা এই, নাগচম্পা। মাঝের বাতাসে শঙ্খ দেখবি ডাক মিশিয়ে।


– উঁহু, আমি তাকে একে অন্য নামে চিনি। প্রেমনলিনী।


– ত্রৈলোক্যমোহিনী হচ্ছিস পূর্ণা? হিসহিসে, খয়েরি জাদুমুগ্ধতা ছেয়ে বসে তোর কন্ঠমণিতে। নড়তে পারি নে। কোদালে কুড়ালে মেঘে ঝেঁপে বৃষ্টি হয়। জানিস তো? তোকে দেখলেই আমার অমন খণ্ড খণ্ড মেঘ বলে ভ্রম হয় আজকাল। নীলচে ধবল, জমাট গরলধারা। 

এদিকে আয়নায় যাকে দেখি রাতে শোওয়ার আগে, জানলা বেয়ে আসা ল্যাম্পপোস্টের গ্যাজলা হলদে আলোয়, দিন কে দিন কেমন কটকটি ব্যাঙের মত লাগে মাইরি। ঘ্যানর ঘ্যানর করে খুঁচিয়ে চলে :

"দূরে সভা নিকট জল, নিকট সভা রসাতল।"


কামিনী ফুলের গন্ধ ভারী মিষ্টি। সত্যিই।

No comments:

Post a Comment