দুপুর গড়ানে এক চিলতে রুগ্ন আলো দাঁড়িয়ে পূর্বমুখী। আলসে এলান রাস্তাটার ঠিক মাঝ বরাবর।
বামধারের ধুমসো দোতলার একটেরে বারান্দাটা নাক গলিয়েছে রাস্তার চৌহদ্দিতে। ওখানেই জাবনা পাত্র আকারের এক বড় টবেতে রাখা জুঁইয়ের মাঝারি গোছের এক ঝোপের সঙ্গে প্রাণপণে চেষ্টা চালায় ওধারের স্বর্ণচম্পক দুটোকটা প্রাণের কথা বলতে।
জুঁই বেচারি রিনরিনে কিশোরী কিন্তু ডানধারের স্বর্ণচম্পক তো ছটফটে কিশোর। সে কি সাহসে কারোর চেয়ে কম যায়! ডালপালা ঝাপটিয়ে ঠেলেঠুলে প্রায় ঢুকেই পড়ে বারান্দার আঙিনায়। পর্বমধ্যে টুকুস টাকুস বারকয়েকের ছোঁয়াছুঁয়িও ঘটে।
হিল্লোল ওঠে খলবলিয়ে।
মাঝে পড়ে রাস্তারই যত বিড়ম্বনা। এ দুয়ের যাবতীয় গোপন গল্পেরা তার বুকেই ঠাঁই নেয় কিনা! ঝরা পাতা আর ফুলের শরীরে ইকিড়মিকিড় লেখাজোখা সেই দলিল দস্তাবেজ রক্ষণাবেক্ষণ কম বড় কাজ বুঝি?
সবটাই পারে এমন দাবী তার নেই কিন্তু চেষ্টার খামতি যে নেই পথের সেটা বোঝে এই চিলতে আলো।
নিজে থেকেই এগিয়ে আসে টুকুন সাহায্য করতে, সঙ্গে সেই সে মাঠ চরা ক্ষুদে ক্ষুদে ঘুর্ণিবাতের থেকে সেধে মেগে নিয়ে আসে এক চুবড়ি চিকন বাতাস। ভারী বাধ্য স্বভাবী।
তো সেই ঝিরিঝিরি বাতাস আলতো পরশে দোঁহার আলাপচারিতাদের গুছিয়ে রাখতে শুরু করে পথের দুই ঢালের খাদে, হিলহিলে পগারের সীমানা বরাবর। ফিনফিনে আলো এদিক সেদিক পাতার ফাঁকে ফোকরে চলাচল করে, দিশা দেখায় কচি বাতাসীকে।
কখনো কখনো গুছানোটা হয়ে ওঠে, স্বস্তিতে ফিরে যায় পথের গায়ে মাথায় টুকদু আদর বুলিয়ে।
কিন্তু অধিকাংশ দিনই যেটা ঘটে তা হল স্রেফ এতোলবেতোল হয়ে যাওয়া, ছিটকে ছিটিয়ে যাওয়া সমস্ত বলাকওয়াদের।
কে জানে কোথায় ঘাপটি মেরে বসে থাকে বেদম ঝঞ্ঝার টুকরোরা, এরা কাজ শুরু করতেই ঝাপট মারে এলোপাথাড়ি। পলকে বেসামাল অতীত বর্তমান। ছিঁড়েখুড়ে একসা খোয়াবের খতিয়ান। কুটিল পাঁশুটে মেঘের খণ্ড আগলে দাঁড়ায় রুগ্ন আলোর চলা। কমজোরি এরা ভয়ার্ত যন্ত্রণায় ঠকঠকিয়ে দেখে খলখল তাণ্ডব। কাঁদতেও আতঙ্ক তাড়া করে। থরথরিয়ে নিজেরাই খিঁমচে ধরে নিজেদের যন্ত্রণানীল হৃদয়।
কোথা থেকে যেন খবর পায় সন্তাপ মোছা বৃষ্টি। ছুটে চলে আসে সব ইজারাদার গিঁটেদের বাঁধন ছুটিয়ে। জড়িয়ে ধরে বন্ধুতার আবেগে। এদের কান্নারা মিশে যায় ওর মরমী আর্দ্র বুকে।
হুতাশ খানিক প্রশমিত হলে ধীরে ধীরে ধুমসোর পাঁচিলটায় ঠেস দিয়ে বসে মরামরা আলো ও নিঝ্ঝুম বাতাস। শ্রান্ত বুকভাঙা রাস্তার ঠোঁটে গলায় টুপটাপ গলে পড়ে স্বর্ণচম্পকের ক্লান্ত ঝরাজল। জুঁই নিথর ঝুঁকে বসে থাকে ন্যাতানো পাপড়িদের ছেঁড়া টুকরোগুলো জড়িয়ে।
ওদের ক্লান্ত ঝিমঝিম গলায় বলে ওঠা পংক্তিরা স্পর্শ করে আমার অথচ আমারই না চেনা এক সত্ত্বার লুকোনো মায়াময় তন্ত্রী। শুনতে পাই--
...
আসলে কী জানিস, ডালের গায়ে পাতার আড়ালে কুঁড়ি হয়ে থেকে যাওয়াই ঠিক বোধহয়। কিম্বা তাও নয়, শিকড়, শিকড়েই একরকম ফুল হয়ে থেকে যাওয়া যেত যদি বা শিকড়ই হত ফুল তা খুবসম্ভব অনেকখানি নিশ্চিন্ততার।
ধর কেন, জুঁই আর স্বর্ণচম্পক যদি একই মাটিতে প্রোথিত শিকড়ে জন্মাত, তলায় তলায় আঁকড়ে বাঁচতে পারত সবার অলক্ষ্যে বেড়ে ওঠা পরস্পরের আকুতিকে, বেশ হত।
উপরতলার গুচ্ছের অসম প্রেমের পাহারাদারেরা থোড়াই হদিশ পেত এদের নিটোল অমলিন প্রণয় যাপনের।
ফুল পাতা হতে গিয়ে, সুন্দরতার দর্শনমাধুর্য সার্বিক করতে গিয়েই যত বিপত্তি।
হিংসাত্মক এক হিংসুটেপনার থাবা গেড়ে বসে আছে এরা অহর্নিশ। তাদের মোটাবুদ্ধি খরখরে মগজে এটা তো ঢোকেনা যে, অ আ ক খ মানেই যেমন কাব্য নয়, বিশেষ শারীরিক প্রত্যঙ্গও মাত্রেই তেমন স্থূল যৌনতা নয়।
দুটি পরস্পরের মর্মস্পর্শী অস্তিত্ব পাশাপাশি কিম্বা মুখোমুখি একে অপরকে আঁকড়ে জড়িয়ে থাকার মুহূর্তের পাঁচশো পচানব্বইটা অর্থ হওয়া সম্ভব। সেটা কেবলমাত্র একমাত্রিক জান্তব সম্ভোগ নয়।
ক্ষমতাধর অর্বাচীনের দল নির্লজ্জের দাম্ভিকতায় শ্বাসরোধ করে নিঃশেষ করে সুকোমল যত ঈশ্বরী প্রবৃত্তির।
রবিবাবুর রক্তকরবীর সেই সর্দার হয়েছে যেন এক একখান সব ভাবনাচিন্তায়!
ঠিক হ্যায়। আজ হেরেছি। কালও হয়ত হারব। হয়তোবা পরশুও। কিন্তু লড়াই তো নেহী ছোড়েঙ্গে। আলবিদা কক্ষনো বলব না।
পরশুর পরের দিনটা আমাদের হবে। আমাদের।
হবেই।
...
বেলাশেষ এগোয় সন্ধ্যাকালে। আলো ধীর পায়ে চলে যায় দিকচক্রবাল হতে নিজেকে মোছার কর্তব্যে। চিকন বাতাস মৃদুল চলনে সরে যায় দূরে, অনেক দূরে।
জুঁই আস্তে আস্তে মুখ তোলে, গুটিসুটি কুঁড়িরা ফুটিফুটি করছে সর্বাঙ্গে। অসহায় অথচ অপার্থিব কলজেছেঁড়া হাসি জাগে তার চোখে ঠোঁটে নাকের পাটায়। স্বর্ণচম্পকের নির্নিমিখ চেয়ে থাকা শ্রান্ত তৃপ্তি মাখে।
জয়দর্পী সেপাই সান্ত্রীদের আত্মতৃপ্তিতে সাময়িক ঢিলেমি আসে নজরদারিতে আর এদের কাছে সুযোগ আসে আরেকবার, দূরবাসী সত্ত্বেও আকণ্ঠ ভালবাসবার।
নিজেকে মুছতে মুছতেই ওদের উদ্দেশে এক কোশ অকৃত্রিম ভাললাগা বাতাসীর পাখনায় ছুঁড়ে দেয় সহমর্মী আলো।
কনে দেখা আলো বলি যাকে।
বামধারের ধুমসো দোতলার একটেরে বারান্দাটা নাক গলিয়েছে রাস্তার চৌহদ্দিতে। ওখানেই জাবনা পাত্র আকারের এক বড় টবেতে রাখা জুঁইয়ের মাঝারি গোছের এক ঝোপের সঙ্গে প্রাণপণে চেষ্টা চালায় ওধারের স্বর্ণচম্পক দুটোকটা প্রাণের কথা বলতে।
জুঁই বেচারি রিনরিনে কিশোরী কিন্তু ডানধারের স্বর্ণচম্পক তো ছটফটে কিশোর। সে কি সাহসে কারোর চেয়ে কম যায়! ডালপালা ঝাপটিয়ে ঠেলেঠুলে প্রায় ঢুকেই পড়ে বারান্দার আঙিনায়। পর্বমধ্যে টুকুস টাকুস বারকয়েকের ছোঁয়াছুঁয়িও ঘটে।
হিল্লোল ওঠে খলবলিয়ে।
মাঝে পড়ে রাস্তারই যত বিড়ম্বনা। এ দুয়ের যাবতীয় গোপন গল্পেরা তার বুকেই ঠাঁই নেয় কিনা! ঝরা পাতা আর ফুলের শরীরে ইকিড়মিকিড় লেখাজোখা সেই দলিল দস্তাবেজ রক্ষণাবেক্ষণ কম বড় কাজ বুঝি?
সবটাই পারে এমন দাবী তার নেই কিন্তু চেষ্টার খামতি যে নেই পথের সেটা বোঝে এই চিলতে আলো।
নিজে থেকেই এগিয়ে আসে টুকুন সাহায্য করতে, সঙ্গে সেই সে মাঠ চরা ক্ষুদে ক্ষুদে ঘুর্ণিবাতের থেকে সেধে মেগে নিয়ে আসে এক চুবড়ি চিকন বাতাস। ভারী বাধ্য স্বভাবী।
তো সেই ঝিরিঝিরি বাতাস আলতো পরশে দোঁহার আলাপচারিতাদের গুছিয়ে রাখতে শুরু করে পথের দুই ঢালের খাদে, হিলহিলে পগারের সীমানা বরাবর। ফিনফিনে আলো এদিক সেদিক পাতার ফাঁকে ফোকরে চলাচল করে, দিশা দেখায় কচি বাতাসীকে।
কখনো কখনো গুছানোটা হয়ে ওঠে, স্বস্তিতে ফিরে যায় পথের গায়ে মাথায় টুকদু আদর বুলিয়ে।
কিন্তু অধিকাংশ দিনই যেটা ঘটে তা হল স্রেফ এতোলবেতোল হয়ে যাওয়া, ছিটকে ছিটিয়ে যাওয়া সমস্ত বলাকওয়াদের।
কে জানে কোথায় ঘাপটি মেরে বসে থাকে বেদম ঝঞ্ঝার টুকরোরা, এরা কাজ শুরু করতেই ঝাপট মারে এলোপাথাড়ি। পলকে বেসামাল অতীত বর্তমান। ছিঁড়েখুড়ে একসা খোয়াবের খতিয়ান। কুটিল পাঁশুটে মেঘের খণ্ড আগলে দাঁড়ায় রুগ্ন আলোর চলা। কমজোরি এরা ভয়ার্ত যন্ত্রণায় ঠকঠকিয়ে দেখে খলখল তাণ্ডব। কাঁদতেও আতঙ্ক তাড়া করে। থরথরিয়ে নিজেরাই খিঁমচে ধরে নিজেদের যন্ত্রণানীল হৃদয়।
কোথা থেকে যেন খবর পায় সন্তাপ মোছা বৃষ্টি। ছুটে চলে আসে সব ইজারাদার গিঁটেদের বাঁধন ছুটিয়ে। জড়িয়ে ধরে বন্ধুতার আবেগে। এদের কান্নারা মিশে যায় ওর মরমী আর্দ্র বুকে।
হুতাশ খানিক প্রশমিত হলে ধীরে ধীরে ধুমসোর পাঁচিলটায় ঠেস দিয়ে বসে মরামরা আলো ও নিঝ্ঝুম বাতাস। শ্রান্ত বুকভাঙা রাস্তার ঠোঁটে গলায় টুপটাপ গলে পড়ে স্বর্ণচম্পকের ক্লান্ত ঝরাজল। জুঁই নিথর ঝুঁকে বসে থাকে ন্যাতানো পাপড়িদের ছেঁড়া টুকরোগুলো জড়িয়ে।
ওদের ক্লান্ত ঝিমঝিম গলায় বলে ওঠা পংক্তিরা স্পর্শ করে আমার অথচ আমারই না চেনা এক সত্ত্বার লুকোনো মায়াময় তন্ত্রী। শুনতে পাই--
...
আসলে কী জানিস, ডালের গায়ে পাতার আড়ালে কুঁড়ি হয়ে থেকে যাওয়াই ঠিক বোধহয়। কিম্বা তাও নয়, শিকড়, শিকড়েই একরকম ফুল হয়ে থেকে যাওয়া যেত যদি বা শিকড়ই হত ফুল তা খুবসম্ভব অনেকখানি নিশ্চিন্ততার।
ধর কেন, জুঁই আর স্বর্ণচম্পক যদি একই মাটিতে প্রোথিত শিকড়ে জন্মাত, তলায় তলায় আঁকড়ে বাঁচতে পারত সবার অলক্ষ্যে বেড়ে ওঠা পরস্পরের আকুতিকে, বেশ হত।
উপরতলার গুচ্ছের অসম প্রেমের পাহারাদারেরা থোড়াই হদিশ পেত এদের নিটোল অমলিন প্রণয় যাপনের।
ফুল পাতা হতে গিয়ে, সুন্দরতার দর্শনমাধুর্য সার্বিক করতে গিয়েই যত বিপত্তি।
হিংসাত্মক এক হিংসুটেপনার থাবা গেড়ে বসে আছে এরা অহর্নিশ। তাদের মোটাবুদ্ধি খরখরে মগজে এটা তো ঢোকেনা যে, অ আ ক খ মানেই যেমন কাব্য নয়, বিশেষ শারীরিক প্রত্যঙ্গও মাত্রেই তেমন স্থূল যৌনতা নয়।
দুটি পরস্পরের মর্মস্পর্শী অস্তিত্ব পাশাপাশি কিম্বা মুখোমুখি একে অপরকে আঁকড়ে জড়িয়ে থাকার মুহূর্তের পাঁচশো পচানব্বইটা অর্থ হওয়া সম্ভব। সেটা কেবলমাত্র একমাত্রিক জান্তব সম্ভোগ নয়।
ক্ষমতাধর অর্বাচীনের দল নির্লজ্জের দাম্ভিকতায় শ্বাসরোধ করে নিঃশেষ করে সুকোমল যত ঈশ্বরী প্রবৃত্তির।
রবিবাবুর রক্তকরবীর সেই সর্দার হয়েছে যেন এক একখান সব ভাবনাচিন্তায়!
ঠিক হ্যায়। আজ হেরেছি। কালও হয়ত হারব। হয়তোবা পরশুও। কিন্তু লড়াই তো নেহী ছোড়েঙ্গে। আলবিদা কক্ষনো বলব না।
পরশুর পরের দিনটা আমাদের হবে। আমাদের।
হবেই।
...
বেলাশেষ এগোয় সন্ধ্যাকালে। আলো ধীর পায়ে চলে যায় দিকচক্রবাল হতে নিজেকে মোছার কর্তব্যে। চিকন বাতাস মৃদুল চলনে সরে যায় দূরে, অনেক দূরে।
জুঁই আস্তে আস্তে মুখ তোলে, গুটিসুটি কুঁড়িরা ফুটিফুটি করছে সর্বাঙ্গে। অসহায় অথচ অপার্থিব কলজেছেঁড়া হাসি জাগে তার চোখে ঠোঁটে নাকের পাটায়। স্বর্ণচম্পকের নির্নিমিখ চেয়ে থাকা শ্রান্ত তৃপ্তি মাখে।
জয়দর্পী সেপাই সান্ত্রীদের আত্মতৃপ্তিতে সাময়িক ঢিলেমি আসে নজরদারিতে আর এদের কাছে সুযোগ আসে আরেকবার, দূরবাসী সত্ত্বেও আকণ্ঠ ভালবাসবার।
নিজেকে মুছতে মুছতেই ওদের উদ্দেশে এক কোশ অকৃত্রিম ভাললাগা বাতাসীর পাখনায় ছুঁড়ে দেয় সহমর্মী আলো।
কনে দেখা আলো বলি যাকে।
No comments:
Post a Comment