Wednesday, February 13, 2019

মরে যাওয়া

আকাশের ঘাড়ে গলায় লেগে থাকা শেষের আলো যে সেসময়ই সমস্তই মুছে গিয়েছিল এমনটা নয়। দিন রয়ে গিয়েছে এটা না বলা গেলেও রাত এসে গিয়েছে এমনটাও বলা যাচ্ছিল না অন্তত চোখ আকাশে রাখলে।
আসলে শ্যামলী কারোর মুখময় লেপা রূপটান মুছতে মুছতে এক দুই পোঁচ রয়ে গেছে যেন কোনও গতিকে, সেটুকু সেটুকু দেখনদার আলো, বাকিটুকু মায়াজড়ানো কালো।

সাঁঝ বাতি হাতে তুলসী তলায় দাঁড়িয়ে এক আঁকশি আকাশ ঠিক অমনপারা দেখে চোখ নামাতেই ঘাই উঠল।
আজ ঠিক তিনটে মাস পেরোল আমার বাবা মরে গিয়েছেন।

হ্যাঁ, অনেকেই মারা গিয়েছেন বলেন বা লেখেন, আমার মরে গিয়েছেন এটা বিশ্বাস করতেই ভাল লাগে।
মরে গিয়েছেন।
নিজে নিজেই মরে গিয়েছেন। বেঁচে থাকাটাও যেমন স্বশর্তে কাটিয়েছেন কোন সে কচিবেলা থেকেই। হাজারো ঝড় ঝাপটাতেও নির্বাচিত পথ পরিবর্তন করেন নি, ঠিক তেমনই মরে গিয়েছেন একসময় নিজের মনমতো খানিক গুছিয়ে গাছিয়ে।
অন্তত মারা যাননি কেউ বা কারোর দ্বারা এটা বাস্তব।
এতে ব্যাকরণগত প্রমাদ কিছু থেকে থাকতেই পারে, কিন্তু এই শব্দদ্বয়ের ফারাক আমার কাছে আজ এমনটাই।

বোকাবোকা ভাবনা। জানি। অত ক্ষমতাধর এ ধরায় কেউ নয়, আমার বাবার মত চূড়ান্ত ছাপোষা মানুষেরা তো ননই। জানি। তবুও ওটাই মানি। আসলে আমিও আমার বাবার মতই অত্যন্ত বোকা মানুষ।

তুলসী মঞ্চে প্রদীপ রেখে সামনে চাইলে দেখা যায় মঞ্চের পিঠ ঘেঁষে পাঁচিলটা, তার পরেই ছাইছাই পুরোনো পিচের আধভাঙা রাস্তার ওপাশে স্ট্রিট লাইটের ফ্যাটফ্যাটে সাদা আলো জুড়ে আছে পথ ও ওধারের খানিকটা, এরপর পোলের ওপাশে ক্রমশ আলো ক্ষীয়মান হতে হতে ডুবে গেছে জমাট নিকষ কালো তে। এ কালো বড় দমচাপা। ভয়াল। বড় জাগতিক আঁধার। বোল নেই, চাওয়া নেই, কেবল আগ্রাসী খিদে। অস্তিত্ব গিলে খাওয়ার, সবটা জোর নিংড়ে নেওয়ার। একলা, ভীষণ একলা বোধ করানো স্বার্থপর কুলিশ এ কালো।

ঠকঠক করে কেঁপে ওঠে গোটা ভেতরবাহির। গুটিয়ে যেতে চায়, কুণ্ডলী পাকাতে চায়। প্রাণপণে নিশ্চুপ চীৎকার উঠে আসে তুলসী মঞ্চের মাটিতে মিশে যাওয়া বাবার অস্থিভস্মের উদ্দেশে। ভয় করছে বাবা। খুব ভয় করছে।
সেই মুহূর্তেই অপার্থিব নাড়া লাগে ক্লান্ত বোধ-ঝোরায়। রুগ্ন ক্ষীণশরীরী বাতি শিখা টপটপ করে ঝরায় কয়েক বিন্দু ধী-জল শুখা হৃদ কোটরে।

আবারও আকাশেই চাইতে বলেন সুগহীনে বসে থাকা ভদ্রলোক।
দৃষ্টি ফেরাই উপর পানে। আস্তে আস্তে বুঝতে পারা যায় কেন এমন অলখ নির্দেশ।

সন্ধ্যালগ্ন বিষাদী আকাশের কাছে ডাকা কালোতে নিজেকে সঁপে দেওয়া যায়। মর্মসহচর সে। তার বুকে রাখা যায় ব্যক্তিগত শোক। সে কালোর ভেতরে অপার স্বান্ত্বনাদাত্রী আলো জেগে থাকে জড়িয়ে জাড়িয়ে। জ্বলতে থাকা চোখে এনে দেয় একমুঠো দুখপ্রশম কান্না। আবার খানিকক্ষণ পেরোলে ডুকরে ওঠা হাহাকার করা একাকীত্ব কে শোনায় :

"জাতস্য হি ধ্রুবো মৃত্যুর্ধ্রুবং জন্ম মৃতস্য চ ।
তস্মাদপরিহার্যেহর্থে ন ত্বং শোচিতুমর্হসি ॥ "

No comments:

Post a Comment