Saturday, January 18, 2020

শোকগর্ভা

পাঁজরার খাঁজে কোনও গতিকে সিঁটিয়ে থাকা পাতলা কাতর মাংস ছেতরে ঝুলছে।
তাদের
জংধরা এক কাঁচির খুনে ডগায় খুঁচিয়ে চলেছে নিষ্পাপ নিয়তি।

নিমেষ তক রেয়াত না দেওয়া ঘাড় ভাঙানি ঢেউরা দাপানির উমান দিতে ব্যস্ত।
তাদের
নির্মম দবদবায় ঘাই ফেরতের অবসর পাচ্ছে না ফিরতি ঢেউ।

জুঁইয়ের খরখরে পাপড়িরা ছুঁয়ে ফেলা থালাবাসনে রেখে গেছে বাসী রক্তের ছোপ।
কাঠ কাঁচের ঘেরাটোপে মমি হয়ে দেওয়ালে লেগে আছে কিছু মরে যাওয়া মুহূর্তেরা।
চন্দনের শখানেক মামড়ি ইতিউতি উড়ে ছড়িয়ে দিয়েছে সংক্রামক শোকগর্ভা ক্ষোভ।

আশপাশ ছেয়ে কেবল কনকনে একলাবোধি ঝাপটা।
চামড়া চিরে ফেঁড়ে ফালাফালা করা অগুণতি মৃত নখের ঝড়।

মৌলা মেরে লে হি লে মেরি জান।

দেদীপ্য শতদল

এটা একটা স্রেফ কিছুমিছু। মণিকর্ণিকার কিছু ছবি দিয়েছেন Swati Sanyal স্বাতী সান্যাল। সেগুলো দেখেই এগুলো ওগরালাম আর কী!

"এ পিত্থিবির গভ্যের সবচে' আদরী ফসল ঝে ধান্য, তার টান জীবির জিভ ত্যাগ দিলি ভাববা সে জীবির শরীল ত্যাগ দেবার সময় এ্যসি গ্যেছে। আরও জোরালো গোপন টান দেছে তারে অন্য ভুবন। তারে যাতি হবে নে এইবেলা। চক্কু মুদলিই দুই ভুরুর মদ্যি কেডা ঝ্যান ফুকারি ফুকারি ওঠে,
'চল গো, নাও তৈয়ের, ঝা কিছু সত্যকার সঞ্চয়, ঝোলায় ভর আর এগোউ দেকি ঘাটের দিকি। কী কও? বলি যাবা? কারে কী বলি যাবা? এইডে করবা? ওইডে করবা? হা হা হা! অখন তো মণি তুমি মরবা! জিরোনের বেলাটুকুও আর নাই গো, বলা কওয়া থাকল আধসারা। লগিদে ঠ্যেল দে দেছে রে নাও, মাঝি সে নিঠুর নিয়তি পারা।'
জিভ আড় জুড়লো তো বোঝপা মরণও আড় ভাঙল।"

স্বাদকারক অসহায় ভবিষ্যদ্রষ্টা, সর্ব্বপ্রথম সে পায় আগত মৃত্যুর লবণাক্ত আঘ্রাণ।
ঈশ্বরীর কাঁখে চিতানির্বাণ কলস, জগৎ বেড় দিয়ে ঘেরে নির্ঘুম মণিকর্ণিকা মশান।

"মায়ার সমসার, বুঝলা মণি?
টান তারিরো বড় কম তো নয়, জেবন শিকলি ছিঁড়তি সে বহু ঝটাপটিই চলে জীবির করোটি আর পঞ্জরের। কিন্তু তারেও পরাস্ত হতিই হয় একসময়। প্রাণবায়ু ডগায় বেঁধোয় ভবিতব্য খঞ্জরের। তখন মাসমেদের শরীল ঘেরে জ্বলন্ত কাঠ আর আগুনের ছপটি পড়ে বাসনার শরীলে।
জীবাত্মা আর কী করে বল দিন্ বেচারা,  আছাড়িপিছাড়ি খায় গতিপ্রাপ্ত আত্মজনের নিরালম্ব অস্তিত্বি। এই অ্যাতোটুক অ্যাতোটুক মিঠেকড়া কামনার সব ঘা খাওয়া টুকরোসকল কুচি কুচি ছিটকি পড়ে তেনাদের অশরীলে।"

বিদেহী পূর্বজ ধারণ করেন অনুজের অবোধ আকাঙ্ক্ষা, সার্থক হয় উত্তরপুরুষের সপিণ্ডকরণ।
অশান্ত চাহিদার গনগনে অগ্নি পথ অতিক্রম করে বায়ুভূক, জাগে অচঞ্চল শিখা নীল নির্বাণ।

"ফুলকি ওড়ে কেবল, অজস্র ফুলকি।
মনে লয় য্যান 'আকাশস্থ নিরালম্ব বায়ুভূক নিরাশ্রয়' রাশি রাশি আলোর পাপড়ি।
নিরুচ্চার তরঙ্গ ওঠে :
আমরা আছি গো, সব্বাই আছি, তোমাগের মধ্যিই আমরা বাঁচি।"

উত্তরপুরুষ ছায়া অপসৃয়মান, রাত বাড়ে, ঘুম আসে।
কেবল সৃজন জুড়ে এক দেদীপ্য শতদল জাগে।

কাটাকুটি বন্দিশ

একসময় পেভমেন্টওয়ালা চওড়া পথ যা সিধে নিজেকে বিছিয়ে রেখেছে আমার নাক চোখ কুঁচকে দেখতে পাওয়ার পরেও কে জানে কত হাজার মাইল, তাকে উৎসবে নিজের বেণী বাঁধতে পাওয়া দুধারে চিকচিকে জরি সেলাই করা চকচকে কালো ফিতের সমান আবেগ ও আনন্দের কারণ মনে হত।

জেব্রাক্রসিং বস্তুটা আদতে হল খুব লক্ষ্মী, সমস্ত নিয়ম মানা শহুরে কচিকাঁচাদের কিতকিত খেলার একমাত্র মোক্ষম জায়গা, এক নিয়ম ভাঙা মফস্বলি খুকির ঠিক এরকম ঠাওরানোর বয়স সেটা।
...

আজকাল কোন কোন দিন কোনও চওড়া পথের পাশে দাঁড়ালে শিরশির করে পায়ের চেটো। অ্যাসফল্টে গড়া এক অনন্তপ্রসারী অত্যন্ত একঘেয়ে রঙা সরীসৃপের চামড়া ছাড়িয়ে রোদে শুকোচ্ছে নাগরিক যাপন। যা তার বহাল থাকার যাবতীয় রসদের জোগানদার।

গত্যন্তরহীন আমি সেটা পেরোতে গিয়ে হঠাৎই খেয়াল করি জেব্রাক্রসিং আড়েবহরে বেশ খানিকটা।
বিরক্তিকর রিফ্লেক্সে বাম পা কিতকিত খেলার শুরুয়াৎ করে ফেলেই হোঁচট খায়।
...

মুণ্ডুটার এক খোপের বাসিন্দা চড়াই চিড়িক দিলেই আরেক খোপের মালিক দাঁড়কাকে ঠোক্কর মারে খুলিতে।

কিতকিত খেলাটা কোনভাবেই আর সম্ভবপর নয় কারণ এক দীর্ঘদেহী ভদ্রলোকের বাম মুঠোর মধ্যে আমার ডান মুঠো গুঁজিমুঁজি সেঁধোতে পারে না ইদানীং।
...

প্রত্যেক আঙুলে নখের খাঁজে লেগে থাকা পিণ্ড তৈরির তিলের কালি ছাড়া আর যা রয়ে গেছে তা হল মাইলকেমাইল হেলদোলহীন কুচুক্কুরে এক কুৎসিত হেঁটে চলা। জুতোর তলায় কালো খাদান পথ যার গালভরা নাম রেখেছি জীবন।
নিয়তির অনুমোদন মিললে ওরই মধ্যে মধ্যে পেরিয়ে যাচ্ছি কিঞ্চিৎ আলোভালোর ডোরাকাটা মুহূর্তদের। জেব্রা ক্রসিং এর উত্তর আধুনিক ন্যারেটিভ গোছের অনুভব।
অবিমিশ্র ন্যাকামি। প্রতিনিয়তই।

রাত বাড়লে কেবল মাথার মধ্যে রোজনামচার পাতাগুলো কিছুটা অস্থির এপাশ ওপাশ ফেরে। কাটাকুটি বন্দিশের বোল ফোটে।
এই আর কী।

বাঁও মেলে না

(আমার ভাইপো পটলের তার বাবাদাদান, মৃত্যু এবং শ্রাদ্ধানুষ্ঠান সংক্রান্ত রাশি রাশি প্রশ্নের উত্তর দিতে অপারগ হচ্ছি প্রতিদিন। মিথ বা মিথ্যে, মিঠে হলেও, তা দিতে বাধছে। বড্ড অসহায় আজ আমি।)

দুটি নির্ঘুম চোখ পেতে রাখি।
প্রাক্‌ কোজাগরী পরী ওড়া রাত দেখি।
রাতচরা পাখিদল সেরে নিচ্ছে যে প্রতি প্রাহরিক আলোজলে স্নান,
আলোর সে বানে ফলা ডোবাচ্ছে নিরন্তর এক মাথা কুটে চলা আকুতির বাণ।
কিন্তু সমস্যা কী জানলে বাবা, বাণ বিঁধোতে লক্ষ্যবস্তু হাতড়ে চলেছি সেই কোন কালাচবেলা থেকে।
স্বয়ং ঈশ্বর বা ঈশ্বরপ্রতিভের তালাশ।

এক বাঁও মেলে না। দুই বাঁও মেলে না। বাঁও বাড়ে কেবল, মেলে আর না।
আমার মুশকিল আসান বাপ, তাঁরও নতুন সাকিন মেলে না।

একই সঙ্গে আশ্চর্য স্বভাববিরুদ্ধভাবে এবং অত্যন্ত স্বাভাবিকতমভাবেই আজ নিরুত্তর তুমি বাবা।
বস্তুত বাজারকাটতি প্রত্যুত্তর দেওয়ার মত গোছানো সুন্দর শান্তিকল্যাণী সদুত্তর চিরকালের মতনই নেই খুবসম্ভব আজও তোমার কাছে।
মিথ্যে উচ্চারণে আজীবন বড় চোখে লাগা অক্ষমতা তোমার।
মরেও কিস্যু হল না তোমার দ্বারা।
বেঁচেও কিস্যু হল না আমার দ্বারা।

বেশ কথা। আমাকে না হয় থামালে কোনও গতিকে।
আঁখিজলে তর্পণে কেটে যাবে কর গোণা বাকিটুকু বাঁচা।
কিন্তু খুব টের পাচ্ছি,
প্রবলতর উত্তরপুরুষ উত্তরাধিকার চাইবেই উত্তরের আকৃতিতে।
উত্তরোত্তর তীক্ষ্ণ শ্লোগান উঠবে
উত্তর চাই। উত্তর দাও।
আকুতি বাণের দস্তুরমত লক্ষ্যবস্তু জোগাও।

আমরা কী উত্তর রেখে যাব বাবা?
লক্ষ্যবস্তু আসলে কোথায়?
আদৌ আছে কি?

শুভেচ্ছা!

এই যে প্রত্যহ একাধিক আত্মীয় নক্ষত্রমণ্ডল মুছে ফেলে রাত ফ্যাকাসে হয়ে আসে, কতগুলো এলোমেলো বেডসোর ড্রেসিং এর কটন মাথার ওপরে ভাসিয়ে ভোর হয়, হতেই থাকে, অনন্যোপায় হয়েই হতে থাকে, কী ভীষণ একঘেয়ে বোধ হয়।

এই যে প্রত্যেকটি কমলা বোঁটায় অ্যানিমিক পাঁচটা কচি ছানার ন্যাতানো ঠোঁট ঝুলতে থাকে, লাস্ট স্টেজ সিওপিডি রোগীর মত মাস্ক আঁকড়ে অরাজী, দারুণ অরাজী তবু ঝরে যায়, গত্যন্তরহীনভাবে নিমরাজী ঝরতেই হয়, কী ভীষণ একঘেয়ে বোধ হয়।

শরৎ দেখিনা। শরতের সকালও।
দেখতে পাই না বলাই বিধেয়।
অবশ্য একেবারেই যে কিছু দেখতে পাই না তাও নয়।

কেবল নড়বড়ে খাটিয়ায় টানটান খুব চেনা একটা মৃত শরীর দেখতে পাই।
স্রেফ, ওটুকুই।
...
প্রার্থনা করি আপনাদের চোখ জুড়ে থাকুক "অমল ধবল পালে লেগেছে..." ইত্যাদি ইত্যাদি।
বুক জুড়ে আসুক পারিবারিক আনন্দের অমূল্য মুহূর্তেরা।

আসন্ন শারদীয়ার শুভেচ্ছা রইল।